লেবাননভিত্তিক শিয়া মুসলিম সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান শেখ হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় দেশটির রাজধানী বৈরুতের উপকণ্ঠে ইসরায়েলের বোমা হামলায় নিহত হন তিনি।
এমন অবস্থায় সংঘাতে জড়াতে পারে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তৈরি হতে পারে অস্থিরতা। লেবানন ও ইসরায়েলের উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতি এখন কোনদিকে মোড় নিতে পারে।
তাহলে এখান থেকে কোথায় যাবে বিশ্ব পরিস্থিতি? তিনটি প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্য দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
কী করবে হিজবুল্লাহ
হিজবুল্লাহ একের পর এক ধাক্কা খেয়েছে, খাচ্ছে। সংগঠনের কমান্ড কাঠামো ছেঁটে ফেলা হয়েছে। হিজবুল্লাহর ডজনের বেশি শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। পেজার আর ওয়াকিটকির বিস্ফোরণের মাধ্যমে হিজবুল্লাহর যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। একের পর এক বিমান হামলায় চালিয়ে সংগঠনটির অনেক অস্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আল-বাশা বলেন, ‘হাসান নাসরুল্লাহর নিহতের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। হিজবুল্লাহকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এর ফলে হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলে স্বল্পমেয়াদে পরিবর্তন আসতে পারে।’
তবে কট্টর ইসরায়েলবিরোধী এই সংগঠন হঠাৎ করে হাল ছেড়ে দেবে, ইসরায়েলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শান্তির পথে ধাবিত হবে—আপাতত এমন কোনো আশা করা হয়তো ভুল হবে।
হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এখনো সশস্ত্র সংগঠনটির হাজারো যোদ্ধা রয়েছে। তাদের অনেকেই সিরিয়ায় যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা প্রতিশোধের দাবি তুলেছেন।
শুধু কি তাই, হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগার বেশ সমৃদ্ধ। দূরপাল্লার ও নির্ভুল-নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে সংগঠনটির বহরে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের তেল আবিব ও অন্যান্য শহরে হামলা চালানো সম্ভব। তাই নিজেরা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়ে হিজবুল্লাহ এসব অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে।
সত্যিই যদি হিজবুল্লাহ এসব অস্ত্রের ব্যবহার করে ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে ও বেসামরিক মানুষজনকে হত্যা করতে পারে; তাহলে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াও মারাত্মক হবে। পাল্টা হামলায় লেবাননে ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ঘটাবে ইসরায়েল। সেই লড়াই ইরান অবধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
ইরান কী করবে?
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড হেজবুল্লাহর মতো ইরানের জন্যও একটি বড় ধাক্কা। দেশটি ইতোমধ্যেই পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছে। এছাড়া দেশটি তাদের নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনিকেও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে গোপন জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে।
তেহরানের গেস্ট হাউজে ইসমাইল হানিয়ার অপমানজনক হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ ইরান এখনো নিতে পারেনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের বেশ কিছু সশস্ত্র সহযোগী গোষ্ঠী আছে। যেটি তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’।
হেজবুল্লাহর মতো ইয়েমেনে এর আছে হুতি এবং ইরাক আর সিরিয়ায় আছে কয়েকটি গোষ্ঠী। ইরান এসব গোষ্ঠীকে ইসরায়েলে এবং ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে হামলা করতে বলতে পারে।
কিন্তু যেই পদক্ষেপই ইরান নিক না কেন সেটি হবে যুদ্ধের জন্য বন্দুকে চাপ দেয়ার মতো, যাতে তারা জয়ের খুব একটা আশা করতে পারে না।
ইসরায়েল কী করবে
ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ ১১টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলকে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে তা মেনে নিতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দেশের যে কোনো আগ্রহ নেই—তা স্পষ্ট। হাসান নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের আগে এ বিষয়ে সন্দেহ করার সুযোগ থাকলেও এখন আর সেটা নেই।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী মনে করছে, হিজবুল্লাহ এখন দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি দূর না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে দেশটি অবস্থান নিতে পারে। ইতিমধ্যে সীমান্তঘেঁষা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর সম্ভাব্য স্থল অভিযানের প্রস্তুতির ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী।
তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সর্বশেষ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৮ বছর ধরে হিজবুল্লাহ নিজেদের যোদ্ধাদের পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
নিহত হওয়ার আগেও সর্বশেষ প্রকাশ্য বক্তৃতায় হাসান নাসরুল্লাহ তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে সম্ভাব্য ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিষয়ে কথা বলেছিলেন। হিজবুল্লাহপ্রধান এটাকে সংগঠনের জন্য ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি বাহিনীর লেবাননের ভূখণ্ডে প্রবেশ করাটা তুলনামূলক সহজ হবে। তবে ফিলিস্তিনের গাজার মতোই সেখান থেকে বের হয়ে আসাটা সময়সাপেক্ষ হতে পারে। তাতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
নাসরুল্লাহর পরিচিতি, হিজবুল্লাহ যোগদান ও দায়িত্ব গ্রহণ
১৯৬০ সালে জন্ম হাসান নাসরুল্লাহর। ৬৪ বছর বয়সী নাসরুল্লাহ বেড়ে উঠেছেন বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের বুর্জ হামুদ এলাকায়। বাবা আবদুল করিম ছিলেন একজন সাধারণ সবজি বিক্রেতা। তার ৯ সন্তানের মধ্যে নাসরুল্লাহ ছিলেন সবার বড়।
১৯৭৫ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধের মুখে পড়লে হাসান নাসরুল্লাহ শিয়া মুভমেন্ট ‘আমাল’–এ যোগ দেন। পরে কিছুকাল ইরাকের নাজাফে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটান। সেখান থেকে লেবাননে ফিরে আবার আমালে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে দলটি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। এ ঘটনার কিছুদিন আগে লেবাননে আগ্রাসন চালায় ইসরায়েল।
আমাল থেকে দলছুট হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসলামিক আমাল’। দলটি প্রতিবেশি দেশ ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কাছ থেকে উল্লেখ করার মতো সামরিক ও সাংগঠনিক সহায়তা পায়। লেবাননের বেকা ভ্যালিভিত্তিক দল ‘ইসলামিক আমাল’ পরবর্তী সময়ে শিয়া মিলিশিয়াদের সবচেয়ে পরিচিত ও কার্যকর দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। একপর্যায়ে এটিই সশস্ত্র হিজবুল্লাহ সংগঠনে রূপ নেয়।
‘ওপেন লেটার’ নামে একটি প্রকাশনা বের করার মধ্য দিয়ে ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার কথা জানায় হিজবুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে তারা চিহ্নিত করে ‘ইসলামের প্রধান দুই শত্রু’ হিসেবে। সেই সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ডাক দেয় তারা। দেশটিকে আখ্যায়িত করে মুসলিমদের ভূমি দখলকারী হিসেবে।
সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে হিজবুল্লাহতে নাসরুল্লাহর অবস্থান মজবুত হতে থাকে, বাড়তে থাকে দায়িত্ব। নাসরুল্লাহ বলেন, হিজবুল্লাহর একজন যোদ্ধা থেকে তিনি বালবেক এলাকার পরিচালক হন, পরে পুরো বেকা ভ্যালির দায়িত্ব পান, এরপর সংগঠনের বৈরুত শাখার দায়িত্ব নেন।
১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরুল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হন তার পূর্বসূরি আব্বাস আল–মুসাবি।
হিজবুল্লাহপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর মুসাবি হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া ছিল হাসান নাসরুল্লাহর প্রথম কাজ। সে অনুযায়ী ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দেন তিনি। হামলায় একজন নিহত হন। পাশাপাশি তুরস্কে ইসরায়েলের দূতাবাসে গাড়িবোমা হামলায় এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সে ইসরায়েলি দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় ২৯ জন নিহত হন।
নাসরুল্লাহ লেবাননের দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গেও তার যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। একপর্যায়ে ২০০০ সালে সেখান থেকে পিছু হটে দেশে ফিরে যান ইসরায়েলি সেনারা। তবে নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষতিও কম হয়নি। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হয় তার বড় ছেলে হাদিকে।
ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবানন ছাড়লে নাসরুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের প্রথমবারের মতো বিজয়ের দাবি করেন। সেই সঙ্গে নাসরুল্লাহ অঙ্গীকার করেন, ইসরায়েলকে দমন না করা পর্যন্ত তারা অস্ত্র ত্যাগ করবেন না। বলেন, সেবা ফার্মস এলাকাসহ দখল করা লেবাননি সব ভূখণ্ড ছাড়তে হবে ইসরায়েলকে।
এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল–হিজবুল্লাহর মধ্যকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল। তবে ওই বছর হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালালে আট সেনা নিহত ও দুজন অপহৃত হন। পরে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে যুদ্ধবিমান থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রায় চার হাজার রকেট ছুড়ে জবাব দেয়।
৩৪ দিন ধরে চলা ওই লড়াইয়ে অন্তত ১ হাজার ১২৫ লেবাননি নিহত হন, যাদের বেশির ভাগ ছিলেন বেসামরিক লোক। নিহত হন ১১৯ ইসরায়েলি সেনা ও ইসরায়েলের ৪৫ বেসামরিক নাগরিকও। লড়াই চলাকালে ইসরায়েল নাসরুল্লাহর বাড়ি ও অফিসে যুদ্ধবিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে। তবে তিনি অক্ষত থাকেন।
সর্বশেষ হিজবুল্লাহ–ইসরায়েল উত্তেজনা বেড়ে যায় গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে। ওই দিন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের রকেট হামলার জের ধরে গাজায় নজিরবিহীন তাণ্ডব শুরু করে দেশটি। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে মাঝেমধ্যেই ইসরায়েলের অভ্যন্তর ও দখলকৃত গোলান মালভূমি এলাকায় রকেট হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহ।
এসব হামলায় হিজবুল্লাহ আট হাজারের বেশি রকেট ব্যবহার করেছে। ছুড়েছে ইসরায়েলি সমরযান লক্ষ্য করে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন দিয়েও আক্রমণ চালিয়েছে বিভিন্ন ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনায়। বিপরীতে লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানোর পাশাপাশি ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপ ও গোলন্দাজ ইউনিট ব্যবহার করছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।
অতি সম্প্রতি লেবাননে পরপর দুদিন হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনায় হিজবুল্লাহর সদস্যসহ অন্তত ৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন হাজারো মানুষ। এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হিজবুল্লাহ। সংগঠনটির প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, ‘ইসরায়েল সব সীমা লঙ্ঘন করেছে।’ তবে তিনি এ–ও স্বীকার করেন, ওই হামলা তার সংগঠনের জন্য এক ‘নজিরবিহীন ধাক্কা’।
লেবাননে চলমান ইসরায়েলের হামলায় এরই মধ্যে প্রায় ৮০০ লেবাননি প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখো মানুষ।