
যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে তার পিটিশনে স্বাক্ষর করা একজন করে নিবন্ধিত ভোটারকে ৫ নভেম্বর নির্বাচনের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন জোরদার করার উদ্দেশে মাস্কের প্রচারণা গোষ্ঠী ‘আমেরিকা প্যাক’ এই পিটিশনটা তৈরি করেছে।এই পিটিশনে শুধু স্বাক্ষর করার জন্য পেনসিলভেইনিয়ায় ভোটারদের মোটা অঙ্কের ক্যাশ টাকা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন সাতটি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের যে ভোটাররা মার্কিন সংবিধানের একটি সংশোধনীকে সমর্থন করা ওই পিটিশনে স্বাক্ষর করবেন দৈবচয়নের ভিত্তিতে তাদের মধ্য থেকে একজনকে ১০ লাখ ডলার দেওয়া হবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইন বিশেষজ্ঞরা ধারণা প্রকাশ করে বলেছেন, ভোটার হিসেবে কাউকে পিটিশন স্বাক্ষর করানোর বিনিময়ে অর্থ দেওয়ার প্রস্তাবটি মার্কিন আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসি নিউজ মাস্কের টিম ও আমেরিকা প্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।
মাস্কের প্রস্তাব
জর্জিয়া, নেভাডা, অ্যারিজোনা, মিশিগান, উইসকনসিন ও নর্থ ক্যারোলাইনা- এই ছয়টি দোদ্যুল্যমান রাজ্যের ভোটারদেরও আমেরিকান প্যাকের তৈরি করা ‘বাকস্বাধীনতা ও অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষে পিটিশন’ এ স্বাক্ষর করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।এমনকি যারা অন্য ভোটারকে এ বিষয়ে সুপারিশ করবেন, তারা যদি স্বাক্ষর করেন তবে তাদের প্রত্যেককে ৪৭ ডলার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
পেনসিলভানিয়ায় স্বাক্ষর করার জন্য আরও বেশি ১০০ ডলার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ ট্রাম্প ও হ্যারিস, উভয়েরই প্রচারণা শিবির বিশ্বাস করে যে এই দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যটিই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের বিজয়ী নির্ধারণ করে দিতে পারে।পিটিশনটিতে বলা হয়েছে, “সংবিধানের প্রথম এবং দ্বিতীয় সংশোধনীতে বাক স্বাধীনতা এবং অস্ত্র বহনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নিচে সই করে আমি প্রথম ও দ্বিতীয় সংশোধনীতে আমার সমর্থন নিশ্চিত করছি।”
আমেরিকা প্যাক বলছে, যারা পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন তারা মার্কিন সংবিধানের প্রথম ও দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রতি তাদের সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
মাস্ক ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে পেনসিলভেইনিয়ার এক টাউন হলের প্রচার অনুষ্ঠানে প্রথম বিজয়ীর হাতে লটারি-ধাঁচের চেক তুলে দিয়ে এই কর্মসূচি এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছেন।বিবিসি জানায়, এই উদ্যোগের ফলে ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন ভোটাররা নির্বাচনের শেষ দিনগুলোতে প্রচারে সামিল হতে উৎসাহিত হবে।
এটা কি বৈধ?
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক পল শিফ বারম্যান বলেন, “ইলন মাস্কের এই পরিকল্পনা অবৈধ।”তিনি নির্বাচনী আইন সম্পর্কিত মার্কিন কোডের কথা উল্লেখ করে বলেন, ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন বা ভোট দেওয়ার জন্য অর্থ প্রদান বা গ্রহণ করলে আইনি সাজা হিসেবে সম্ভাব্য ১০,০০০ ডলার জরিমানা বা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হাতে পারে।
তবে মার্কিন বিচার বিভাগ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসি ফেডারেল ইলেকশন কমিশনের (এফইসি) সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।ফেডারেল ইলেকশন কমিশনের একজন সাবেক চেয়ারম্যান জানান, এই উদ্যোগটি বেশ কৌশলের সাথে পরিচালনা করা হচ্ছে। কারণ নিবন্ধন বা ভোট দেওয়ার জন্য কাউকে সরাসরি অর্থ দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, “মাস্ক ভোট দেওয়ার জন্য তাদের টাকা দিচ্ছেন না। তিনি একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করার জন্য তাদের অর্থ দিচ্ছেন। তিনি চান যারা ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধিত শুধু তারাই পিটিশনে স্বাক্ষর করুক। সুতরাং আমি মনে করি সে এখানে ঠিক আছে।”
তবে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী আইনের অধ্যাপক মাইকেল কাং বিবিসিকে বলেছেন, “আমি বুঝতে পারছি কিছু বিশ্লেষণে এটি বেআইনি নয়। কিন্তু আমার মনে হয়, এখানে প্রসঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে এটিকে স্পষ্টভাবে মানুষকে ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে প্ররোচিত করতে পরিকল্পনা করা হয়েছে যা আইনত সমস্যাযুক্ত।”
নির্দলীয় ক্যাম্পেইন লিগ্যাল সেন্টারের আদাভ নোটি বলেন, “মাস্কের পরিকল্পনা ফেডারেল আইন লঙ্ঘন করেছে আর এটি দেওয়ানি বা ফৌজদারি বিষয় তা বিচার বিভাগের দেখা উচিত। ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করবেন এই শর্তে অর্থ প্রদান করা বেআইনি।”নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ল’র সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক জেরেমি পল বিবিসিকে পাঠানো এক ইমেইলে বলেন, “মাস্ক আইনি ফাঁকফোকর ব্যবহার করে সুযোগ নিচ্ছেন।”
পেনসিলভানিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নর জোশ শাপিরো এই পদক্ষেপকে ‘খুব উদ্বেগজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।জবাবে মাস্ক বলেন, “তার (শাপিরোর) এ ধরনের মন্তব্য বরং উদ্বেগজনক।”
কোনো নজির আছে কি?
মাস্ক এই সমালোচনার বিরোধিতা করে যুক্তি দিয়েছেন যে ডেমোক্র্যাটরা এবং তাদের দাতারা অতীতে একই ধরনের উদ্যোগে অর্থায়ন করেছে।সামাজিক মাধ্যম এক্স এ তিনি একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন যেখানে বলা হয়েছে যে মেটার বস, মার্ক জুকারবার্গ ‘২০২০ সালেও একই কাজ করেছিলেন’।জাকারবার্গ ২০২০ সালের নির্বাচনে ৪০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছিলেন, কিন্তু পোস্টাল ব্যালট সরবরাহে সহায়তা করার জন্য দুটি নির্দলীয় সংস্থাকে তা দেওয়া হয়েছিল। তা সরাসরি ভোটারদের দেওয়া হয়নি।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সমর্থকদের তৎপরত করতে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে ‘ভোটার নিবন্ধন’ প্রচারণার মতো উদ্যোগে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছিল। তবে এই অর্থও সরাসরি ভোটারদের দেওয়া হয়নি।অধ্যাপক ক্যাং বলেন, “ভোটারদের নিবন্ধন করে দেওয়ার জন্য যাওয়া লোকজনকে অর্থ প্রদান করা বৈধ, কিন্তু আপনি নিবন্ধনের জন্য লোকজনকে সরাসরি অর্থ দিতে পারবেন না।”
মাস্ক আর কী করেছেন?
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার সঙ্গে মাস্কের সুসম্পর্ক না থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে মাস্ক।২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ছাড়ার ঘোষণা দেন এবং তার অনুসারীদের রিপাবলিকান পার্টিকে ভোট দিতে উৎসাহিত করেন।চলতি বছর মাস্ক মার্কিন রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এমনকি বেশ কয়েকজন রিপাবলিকানের পক্ষে অনুদান দিয়েছেন এবং তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার চালিয়েছেন।
২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের প্রচারণাকে সমর্থন করার লক্ষ্যে জুলাইয়ে ‘আমেরিকা প্যাক’ চালু করেন মাস্ক। এখন পর্যন্ত তিনি দলটিকে অন্তত সাত কোটি ৫০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছেন।আমেরিকা প্যাকের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তারা ‘নিরাপদ সীমান্ত’, ‘নিরাপদ শহর’, ‘বাকস্বাধীনতা’, ‘যৌক্তিক ব্যয়’, ‘ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা’ এবং ‘আত্ম-সুরক্ষা’ চায়।