কোরবানি সাধারণ কোনো ইবাদত নয়। বরং এটি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম আমল। পবিত্র কোরআনে কয়েকটি স্থানে কোরবানি প্রসঙ্গ এসেছে। কোরবানি করার সরাসরি নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সুতরাং আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার: ২) রাসুল (স.) মদিনার জীবনে প্রতিবছর কোরবানি করতেন। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (স.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করছিলেন, প্রতিবছর তিনি কোরবানি করেছেন।’ (ইবনে মাজাহ: ৩১২৭)
কোরবানির উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। হজরত ইবরাহিম (আ.) নিজের প্রিয়পুত্রকে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর তাতেই আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হয়েছেন। ফলস্বরূপ ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এবং প্রিয় সন্তানকেও ফেরত পেলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা পিতা পুত্র উভয়ে যখন আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করার জন্য নিজেদের সোপর্দ করল, আর ইবরাহিম স্বীয় পুত্রকে জবাই করার জন্য উপুড় করে শোয়ালো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তোমার স্বপ্নকে তুমি বাস্তবে পরিণত করেছ। এটা ছিল এক মহাপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। আল্লাহ বলেন ‘আমি তার পুত্রের বদলে একটি মর্যাদাবান দুম্বা জান্নাত থেকে পাঠিয়ে দিলাম।’ (সুরা সাফফাত: ১০৩-১০৭)
মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টি যাদের কামনা-বাসনা, তাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। দুনিয়ার সবাই শত্রু হয়ে গেলেও তার ক্ষতি করা যায় না। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি আকাঙ্ক্ষা করে তা মানুষের অসন্তুষ্টির কারণ হলেও, মানুষের দুঃখ-কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ তাআলাই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।’ (তিরমিজি: ২৪১৪)
পক্ষান্তরে যারা দুনিয়ার মোহ বা অন্যকারো সন্তুষ্টি চায়, অকল্যাণ তাদের গ্রাস করে ফেলে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘পার্থিব চিন্তা যাকে মোহগ্রস্ত করবে, আল্লাহ তার কাজকর্মে অস্থিরতা সৃষ্টি করবেন, দারিদ্র তার নিত্যসঙ্গী হবে এবং পার্থিব স্বার্থ ততটুকুই লাভ করতে পারবে, যতটুকু তার তকদিরে লিপিবদ্ধ আছে। আর যার উদ্দেশ্য হবে পরকাল, আল্লাহ তার সবকিছু সুষ্ঠু করে দেবেন, তার অন্তরকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করবেন এবং দুনিয়া স্বয়ং তার সামনে এসে হাজির হবে। (ইবনে মাজাহ: ৪১০৫)
তাই প্রত্যেকের উচিত, সবক্ষেত্রে পরকালকে প্রাধান্য দেওয়া, আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া। কোরবানি আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় আমল। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, কোরবানির ঈদের দিন মানুষের সব নেক আমলের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় আমল হলো কোরবানি করা। কেয়ামতের ময়দানে জবেহকৃত জন্তু তার শিং, লোম, খুরসহ এসে হাজির হবে। নিশ্চয়ই কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা খুশি মনে আনন্দচিত্তে কোরবানি করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩১২৬)
গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার এক অনন্য ইবাদত কোরবানি। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ফাতিমা (রা.)-কে বলেন, তুমি তোমার কোরবানির জন্তু জবেহর স্থানে উপস্থিত থাকো। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার অতীতের সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন। ফাতিমা (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এই গুনাহ ক্ষমা হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য খাস, নাকি সব মুসলমানের জন্য? নবীজি বললেন, আমাদের ও সব মুসলমানের গুনাহ ক্ষমা করা হবে। (মুস্তাদরাক হাকিম: ৭৬৩৩)
কোরবানি জাহান্নামের প্রতিবন্ধক। আবদুল্লাহ ইবনে হাসান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি খুশি মনে সওয়াবের আশায় কোরবানি করবে, ওই কোরবানির জবেহকৃত পশু কোরবানিদাতার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হবে।’ (আল মুজামুল কাবির: ২৬৭০)
কোরবানি এমন ইবাদত, যার পশমে যমমে নেকি। অর্থাৎ পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একেকটি নেকি দেওয়া হয়। জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, আমরা রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? রাসুল (স.) বলেন, এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান আছে? জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি চুলের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেওয়া হবে। অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল! পশমের বিনিময়েও কি এ পরিমাণ সওয়াব আছে? রাসুল (স.) জবাব দিলেন, হ্যাঁ, প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি দেওয়া হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩২৪৭)
অন্যদিকে সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি না করা মানুষগুলো নবীজির খুবই অপছন্দের। মহানবী (স.) এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে হাদিসে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (মুসনাদে আহমদ: ২/৩২১)