সাকিবুর রহমান-খুলনা
খুলনার ফুলতলা উপজেলার একটি গ্রামের নাম দক্ষিণডিহি। এই গ্রামে কাঁচা পাঁপড় তৈরির ঐতিহ্য প্রায় ৭০ বছরের বেশি পুরোনো। এখানকার হাতে তৈরি কাঁচা পাঁপড় চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। গ্রামটি এখন পরিচিতি পেয়েছে ‘পাঁপড় গ্রাম’ নামে।
গ্রামে ছোট-বড় পাঁপড় তৈরির কারখানা রয়েছে প্রায় ৫০টিরও বেশি। এ অঞ্চলের বিখ্যাত কাঁচা পাঁপড় তৈরি করেই জীবিকা চলছে দক্ষিণডিহি গ্রামের মানুষের।
দক্ষিণডিহি গ্রামের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস এখন পাঁপড়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ গ্রামের প্রায় সবাই যুক্ত এই পেশার সঙ্গে। দক্ষিণডিহি গ্রামের তৈরি পাঁপড় চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায়।
কারিগররা জানান, এ অঞ্চলের কাঁচা পাপড়ের চাহিদা বেশি থাকায় অনেক সময় তা সরবরাহ করতে হিমশিম খেয়ে যান আড়তদারেরা।
দক্ষিণডিহি গ্রামের পাঁপড় কারখানার মালিক সামাদ মিয়া বলেন, দিনমজুরি করে সংসার চলত না। পরে পাঁপড় তৈরির কাজ শুরু করি। কঠোর পরিশ্রম করে কারখানা গড়ে তুলেছি। এখন কারখানায় প্রতিদিন ১৬ মণের মতো কাঁচা পাঁপড় তৈরি হয়।
খুলনা শহর থেকে ফুলতলার দক্ষিণডিহি গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। ফুলতলা উপজেলা রেখে আরও সাত-আট কিলোমিটার গেলেই দেখা মেলে ‘পাপড় গ্রামটির’। গ্রামের ঠিক মধ্যে রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি। সেটি এখন রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি নামে পরিচিত। তার পাশেই রয়েছে খেলার মাঠ। মাঠে পাটি ও পলিথিনের ওপর শুকানো হচ্ছে কাঁচা পাঁপড়। কয়েকজন কাজ করছেন সেখানে। কেউ শুকানো পাঁপড় তুলছেন আবার কেউবা রোদে দিচ্ছেন।
এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের প্রতি পরিবারের কেউ না কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাঁপড় তৈরির পেশার সঙ্গে যুক্ত।
জানা যায় গ্রামটিতে প্রথম কাঁচা পাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন সতীশ চন্দ্র দত্ত। ধীরে ধীরে সেটি গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সতীশ চন্দ্র দত্তের নাতি আনন্দ দত্ত বলেন, “আমার দাদা এই পাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আমার বাবা সুশীল দত্ত, দাদার মৃত্যুর পর ব্যবসাটির হাল ধরেন এবং এর প্রসার বৃদ্ধি করেন। তিনি আরও জানান, যেহেতু আমার বাবা এখন বয়স্ক এবং অসুস্থ, বর্তমানে আমি ব্যবসাটি চালাচ্ছি। বর্তমানে ৫০ এর অধিক শ্রমিক প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কেজি পাপড় উৎপাদন করেন। আমি বিভিন্ন জেলা, যেমন খুলনা, চট্টগ্রাম, ও ঢাকা বিভাগে পাপড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। বছরে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করেন বলে জানান তিনি।
এই পেশাটি গ্রামবাসীদের জন্য, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য একটি অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে, যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করে চলেছেন। মহিলারা এই শিল্পের প্রতিটি স্তরে সক্রিয়ভাবে যুক্ত, এবং তাদের কাজের মাধ্যমে তারা নিজের পরিবার ও সম্প্রদায়ের জন্য একটি শক্তিশালী আয়ের উৎস তৈরি করেছেন। পাপড় তৈরির সাথে জড়িত গৃহবধু মাহমুদা খাতুন বলেন, মুগ, মাষকলাই ও খেসারির ডাল একসঙ্গে মাড়াই করে গুঁড়া করা হয়। পরে ওই গুঁড়ার সঙ্গে পরিমাণমতো পানি, লবণ, খাওয়ার সোডা ও কালিজিরা মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। ওই মণ্ড থেকে হাতের মাপে ছোট ছোট গুটি তৈরি করা হয়। প্রতিটি গুটিতে তৈরি হয় একেকটি পাঁপড়। এই গুটি চালের গুঁড়ার সাহায্যে বেলে পাতলা রুটির মতো তৈরি করা হয়। একসঙ্গে অনেক পাঁপড় তৈরি হওয়ার পর তা রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। কড়া রোদে শুকাতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এরপর তা লম্বা কাগজের শক্ত প্যাকেটে মুড়িয়ে বাজারজাত করা হয়।
প্রায় ২০ বছর আগে এই গ্রামে এক সময় দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন সলেমান শেখ, কিন্তু তাতে সংসার চলতো না। একপর্যায়ে খালি হাতে ফুলতলা বাজারের একটি বড় আড়ত থেকে চাল ও ডাল এনে পাঁপড় বানানো শুরু করেন। এখন তার কারখানাতেই কাজ করেন প্রায় ৭০ জন শ্রমিক।
তিনি বলেন, ‘দিনমজুরি করে সংসার চলতো না। পরে পাঁপড় তৈরির কাজ শুরু করি। সেখান থেকে কঠোর পরিশ্রম করে কারখানা গড়ে তুলেছি। এখন কারখানায় গড়ে প্রতিদিন ২৬ মণের মতো কাঁচা পাঁপড় তৈরি হয়। ২২ লাখের মতো টাকা লেনদেন হয়।
দক্ষিণডিহি গ্রামের বাসিন্দা তাসলিমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ঘরের বারান্দায় বসে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে পাঁপড় তৈরির কাজ করছেন। তাসলিমা বেগম বলেন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট কারখানা থেকে পাঁপড় তৈরির জন্য কয়েক হাজার মণ্ড এবং চালের গুঁড়া দিয়ে যায়। কতগুলো মণ্ড দিয়ে যায়, সেই হিসাব করেন কারখানা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এক হাজার পাঁপড় বেলার জন্য তিনি পান ৭৫ টাকা। এক হাজার পাপড় বেলতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। অবসর সময়ে তিনি ওই কাজ করেন। দিনে দেড় থেকে দুই হাজার পাঁপড় বেলতে পারেন। প্রায় প্রতিটি বাড়ির নারীরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। সবাই অবসর সময়েই ওই কাজ করে বাড়তি আয় করছেন।
ফূলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাসনিম জাহান জানান, দক্ষিণদীহি গ্রামের পাপড় শিল্প স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি গ্রামের মানুষের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে এবং অনেক পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করেছে।
তিনি আরও বলেন, শিল্পটি আরও বিকশিত হলে এটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
স্থা্নীয়দের মতে সারাদেশে দক্ষিণডিহি গ্রামের তৈরি পাপড়ের চাহিদা থাকায় এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বেশ ভালো ভূমিকা রাখছে এই ‘পাপড় গ্রাম’ খ্যাত খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রাম।