আসিফ কবীর
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। গুজব সংস্কৃতি(!) সবসময়ই ছিলো। একসময় গুজব মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে সত্য উদ্ভাসিত হয় সে-ও সত্য। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। যারা গুজব ছড়ান তারা এই অন্তর্বর্তী সময়টিকেই মাথায় রেখে কূটকৌশল নির্গত অপপ্রচার চালান। প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের সময়ে গুজব বেশি করে ডালপালা মেলে। মূল ধারার সাংবাদিকরাও এর বাহন হন। এসব গুজব যখন বাস্তবতার নিরীখে অপসৃত হয় তখনও গুজব রটনাকারীরা লজ্জিত হন না। নতুন পরিকল্পনায় গুজব ছড়ান। গুজব রটনাকারীদের খুঁজে বের করা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেও অনীহা দেখা যায়। ফলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলতে পারে কাজটি। তবে সরকারের বড় সাফল্য ও শক্তিমত্তা প্রমাণের মুখে গুজবকারীরা সাময়িক মুষড়ে পড়েন। তাদের সুর নরম হয়, গা ঢাকা দেন কেউ কেউ। আবার খারাপ কাজের দায় নিতে চান না কোন পক্ষই। ২৮ অক্টোবর সহিংসতা যে সরকারী দল করেনি তা প্রমাণিত। সহিংস কাজের ছবি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদ, প্রত্যক্ষদর্শীরে জবানবন্দি আছে। তবু সরকার বিরোধীরা তা অস্বীকার করেন। সরকারের সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়ন বিঘ্নের জন্য বিরোধীরা কর্মসূচি দেন। তাদের অবরোধ-হরতাল জারি রাখতে অগ্নিসংযোগ করেন তারাই। কারণ সরকার নিজেদের লক্ষ্য পূরণ ব্যহত হয় এমন কাজ করাবে না-সহজেই অনুমেয়। অগ্নি সন্ত্রাসের কারণে সরকারের কোন লাভ তো হয়ই না বরং দুর্বলতা প্রকাশ পায়। তাদের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়, বাধাগ্রস্ত হয়। সেক্ষেত্রে সরকারের একাজটি করার কোনই মানে নেই। বিরোধী পক্ষের লোকরা বলেন, বিরোধীদের হেয় করতেই সরকারই এমন কাজ করায়। তারে জনপ্রিয়তা ক্ষুন্ন করতে, গণশত্রুতে পরিণত করতেই সরকারের মদেই এসব হয়। অথচ সরকারতো বিরোধীদের অস্তিত্বই স্বীকারের পক্ষপাতি না। তাহলে কেন তারা মদ দেবে? বরং যারা কর্মসূচি দেয় ও তা সফল করতে মানুষকে ভয় খোতে চায়, সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে চায়- নিঃসন্দেহে এসব তাদেরই কাজ। মানুষের বিবেচনা বোধকে উপহাস করে অগ্নি সন্ত্রাসের দায় এড়ানোর সুযোগ বিএনপি বা তাদের সমমনাদের নেই।
মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোরটোপে মানুষ হয়রানির স্বীকার হতে চান-না। রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলি জনসমর্থন পায় না। তাই মানুষকে বাধ্য করতে সহিংসতা চালায় বিরোধীরা। মূলধারার গণমাধ্যম ও দায়িত্বশীল সূত্রে লাগামহীন সরকারের সমালোচনা করা যায় না। তাই বাহন করা হয় গুজব ও অপপ্রচার চালানোকে। অনেকদিন শান্তিপূর্ণ দিনাতিপাতের পর সহিংসতায় একদমই অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তারা এসবের পুনরাবৃত্তি চান-না। সরকার সমর্থকরাও দীর্ঘ ক্ষমতাকালে দুর্বল বিরোধী দল, রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জহীনতা ও গঠনমূলক সমালোচনার অনুপস্থিতির জন্য সামান্য বিরূপ অবস্থায়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ বিরোধী যে জনমতটি আছে মাঠ পর্যায়ে তারা তারে অস্তিত্ব জানান দিতে চান, মাঠে আওয়াজ তুলতে চান। কিন্তু বিএনপির দুর্বল নেতৃত্ব, বহুধা বিভক্তি, পারস্পরিক অবিশ্বাস, এশিয়ারও বাইরে আরেক মহাদেশ থেকে প্রবাসে স্থায়ী নেতার অতিশয় কর্তৃত্বপরায়নতার জন্য তৃণমূলের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। সরকার বিরোধী নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বা সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক উপায় : নির্বাচনে বিএনপি বা সমমনাদের অংশগ্রহণ না করা তাদের নেতৃস্থানীয়দের সিদ্ধান্তেই নিষ্ফলাভাবে ঘটে। তৃণমূলের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে নির্বাচন বয়কট নয়, তার প্রমাণ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে বিএনপি নেতাদের প্রার্থী হওয়া।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিটা ঠিকঠাক বোঝেন। মানুষের মনটা পড়তে পারেন। তিনি তার বিমান যাত্রাকালে সাধারণ সহযাত্রীদের সাথে যখন কুশল বিনিময় বা সাক্ষাত করেন, নিজস্বী (সেলফি) তোলেন, তারা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার রুটিন কাজের বাইরে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের প্রথম প্রদর্শনী আমন্ত্রিত সকলের সাথে বসে দেখেন কিংবা শিল্প-সংস্কৃতির উদযাপনে উচ্ছাসভরা প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষ তখন প্রধানমন্ত্রীকে তাদেরই একজন মনে করে পরম আপন ভেবে নেন তাঁকে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এই পাঁচ বছর আ’লীগের নেতৃত্বাধীন ঐক্যমতের সরকারের অর্জন নেহায়েত কম ছিলো না। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বিবাদ পরিস্থিতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরলতম দৃষ্টান্ত সেবারই একমাত্র তৈরী হয়েছিলো। এরপর নির্বাচনে আ’লীগ রাষ্ট্রীয় কূটচালে অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হয়। যা তাদের প্রাপ্য ছিলো না কোনভাবেই। নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় দলটির নেতাকর্মীরা চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। এই সকল অভিজ্ঞতা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ও অন্যের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে দলটিকে চূড়ান্ত রকম নিরোৎসাহিত করে। রাষ্ট্র চিন্তক ও পণ্ডিতদের ভাবনায় থাকা প্রয়োজন ছিলো ২০০১ এর নির্বাচনে অতিশয় কৌশল আশ্রয়ী হওয়ার কুফল সুদূরপ্রসারী হবে এবং এর ক্রীড়নক ও যোগসাজশকারী বা নামান্তরে সুবিধাভোগী বিএনপিকে ভবিষ্যতে অনেক ভোগাবে।
বিগত পনের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে প্রতিটি কাজই সর্বোত্তম ও সঠিক করেছে এমন ধরে নেওয়া যেমন যায় না, তেমনি ত্রুটিমুক্তভাবে সব করতে হবে সে দাবীও ঠিক না। গণমাধ্যম বিজ্ঞানী মার্শাল ম্যাকলুহানের যুগন্বয়ী কথাটি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক: মিডিয়া ইজ দ্যা মেসেজ। গণমাধ্যমের প্রকৃতি অনুসারেই দর্শক-শ্রোতা-পাঠক প্রত্যাশা নির্ধারণ হয়। উদাহরণ হতে পারে পত্রিকায় কেউ অভিও ভিডিও, বেতারে কেউ ছবি, উপাত্ত, গ্রাফ দেখতে চান না। তেমনি সাংবাদিক, বিশ্লেষক, সমালোচকদের অনুসৃত নীতির জন্য শাসক দলের লোকেরাও ধরেই নেন তার সরকার সবই ঠিক করে, ভুল কিছু করতেই পারে না, তাই যেন-তেনভাবে সাফাই দেওয়াই কর্তব্য বা বিধেয়। এই প্রবণতার জন্য সরকার ও তার সর্মকদের সবকিছুরই একটি লাগসই ব্যাখ্যা, যুক্তি এবং দৃষ্টিভঙ্গি তৈরীর বাধ্যবাধকতা পোহাতে হয়। কিন্তু পনের বছরে সর্বাংশে সঠিক কিংবা যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব হয় না- এ বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হলেই সরকারের কাছ থেকে আদায়ের প্রশ্নে যুক্তিগ্রাহ্য তুলনামূলক তালিকা প্রণয়ন সম্ভব। জনগণকে যারা প্রশ্ন করতে শেখাবেন ও অধিকার সচেতন করবেন সেই প্রতিষ্ঠানগুলি পরিসংখ্যানিক ও তুলনামূলক প্রাপ্তির হিসাব করতে আমারে প্রস্তুত করেন না। এতে করে মূল বাস্তবতা উপেক্ষিত থেকে যায়, সুূদূরে থেকে যায় সরকারের কৃতিত্বের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন ও জনসন্তুষ্টির মাপদন্ড। সরকারকে সঠিকভাবে প্রশ্ন করতে শিক্ষণের ক্ষেত্রে সুশীল ও নাগরিক নেতৃবৃন্দের কৌশলে পরিবর্তন প্রয়োজন কিনা সেটি সকলপক্ষের বৃহত্তর স্বার্থেই পুনর্ভাবনার দাবী রাখে।
এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাধা নির্বাচন তৃণমূলে নানা সঙ্কট সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্খা করেন কেউ কেউ। তবে ভিন্নমতও আছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে প্রতিবেদন করে আসছেন প্রায় দুদশক কাল এমন একজন সাংবাদিক জয় যাদবের সাথে কথায়-কথায় অন্য স্কুল অব থটটি জানার সুযোগ হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করে নির্বাচন যেমন র্প্রাীতা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সংকুচিত করেছিলো, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণ না করার সিদ্ধান্ত সেই শূন্যতা হ্রাস করবে। প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যে ওয়ার্মআপ সারতে পারলেন ও জনপ্রিয়তা যাচাই হয়ে গেলো তা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবে। যা এলাকামুখীনতা, জনসম্পৃক্ততা ও মাঠের রাজনীতিতে অধিক মনোযোগের গুরুত্ব আবারও সামনে নিয়ে আসলো। অন্তর্দ্বন্দ্ব বা কোন্দল বড় দলে সবসময়ইথাকে। কিন্তু বহুর্প্রাীর বিকাশ ও প্রকাশমান হওয়ার সুযোগটি ক্ষতির চেয়ে লাভের পাল্লা ভারী করেছে বলে মি. যাদব ব্যাখ্যা করেছিলেন। এবারের মনোনয়ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অতীতে এমপি ছিলেন এমন অনেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। তার মানে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার বিষয়টি স্থায়ী ছিলো না। সে মুহূর্তের পরিস্থিতি বিচারে বা শরীকদের আসন ছাড়ের জন্য সামরিক ব্যবস্থা ছিলো মাত্র। বিষয়টি, একজন রাজনীতিবিদের নিজের ভালো কাজ, যোগ্যতা প্রমাণ, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলে আবারও ফেরা সম্ভব এই বার্তা আমাদের দিয়েছে। এক বা একাধিকবার মনোনয়ন বঞ্চিত হলে প্রার্থী বা তার সঙ্গীয়রা যেমন ভেঙ্গে পড়েন তা একেবারেই সংগত নয়। দলীয় প্রধানে কাছে একটি দীর্ঘমেয়াদী রোডম্যাপ আছে। তিনি প্রয়োজন বিশেষে বিরতি দিয়ে অধিক সংখ্যক রাজনীতিকের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্যই মনোনয়ন পরিবর্তন করেন, অবস্থা তেমনই মনে হয়। কয়েকটি বিরল ও ব্যতিক্রম ঘটনা বাে জনসম্পৃক্ত রাজনীতিকদের কখনোই নির্বাসন ঘটে না।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির অপর একটি দিক হলো পরিবর্তন, সংস্কার ও নীতিগত সিদ্ধান্তে পরমত সহিষ্ণুতা। সরকার বিগত দেড় দশকে নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিলেই কমবেশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু কার্যকর হওয়ার পর সঠিক প্রমাণিত বা অধিক সুবিধা প্রদায়ী বিবেচনায় নন্দিত হয়েছে উদ্যোগগুলি। আবার জনমতকে উপেক্ষা না করে সরকারও সাধারণ বা সংশ্লিষ্টদের উত্থাপিত প্রস্তাবনা আত্মীকরণ করেছে। জনগণের দাবীর প্রতি সরকারের এমন মনোভাব সঙ্কট নিরসন ও জনসমর্থন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, জয়বাংলা ইয়ূথ অ্যাওয়ার্ডের সপ্তম আসারের চূড়ান্ত পর্বে পুরস্কার বিতরণ শেষে, বলেছেন: আগামী দশ-পনের বছরের মধ্যে বিএনপি-জা’মাত বলে কোনো দল থাকবে না। যখন এই জঙ্গিবাদী মৌলবাদী শক্তির চিহ্ন বাংলাদেশ থেকে মুছে যাবে তখন দেশে শান্তি আসবে (১৮ নভেম্বর, ২০২৩, বাসস)। এই বক্তব্যটি আগামীর রাজনীতির দিশারী বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। বিএনপি-জা’মাতের শাসনাধীনে নিশ্চয় এ বিলুপ্তির ঘটনা ঘটবে না। এই প্রহেলিকা যদি এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, আগামী এক-দেড় দশক রাষ্ট্র ক্ষমতায় বর্তমান সরকারী দলের ধারাবাহিকতা থাকবে। এরই রোডম্যাপের আলোকে সজীব ওয়াজেদ আমাদের ভবিষ্যত দেখিয়েছেন- তা অত্যন্ত যুক্তি নির্ভর ভাবনা বলা যায়। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ তার বিরোধীদের বন্ধ্যাত্ব ও রাজনৈতিক অপ্তবুদ্ধির বিপরীতে জনগণকে পক্ষে টানার কৌশল এবং আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ধার্য্য চ্যালেঞ্জগুলি স্বীকরণ করবে। এ প্রক্রিয়ায় সজীব ওয়াজেদের প্রফেটিক কথাটি খেটে যাওয়ার বাস্তবতা বহুলাংশেই আছে।
লেখক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী প্রেস সচিব ও মুজিববর্ষের মিডিয়া কনসালট্যান্ট