প্রাণিসম্পদ খাতের অর্জন
আর ক’দিন পরেই আসছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ইদ উল আযহা বা কোরবানির ইদ। এসময় নির্ধারিত কিছু গৃহপালিত প্রাণি কোরবানির মাধ্যমে বিশে^র ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন। তাই সারাবিশে^র ন্যায় বাংলাদেশেও ইদকে কেন্দ্রকরে কোরবানিযোগ্য প্রাণির বেশ চাহিদা থাকে। আর খামারিরাও তাঁদের লালন-পালনকরা প্রাণিগুলো বিক্রির জন্য সময়টির অপেক্ষায় থাকেন, কারণ এই সময়ে ভালো দামে প্রাণি বিক্রির সুযোগ পাওয়া যায়। তাই ধরেই নেয়া যায় দেশের খামারিরা যে গরু-ছাগল-মহিষ পালন বা মোটাতাজা করেন তার বড় একটি অংশই কোরবানির ইদে বিক্রির উদ্দেশ্যে করে থাকেন। তবুও একটা সময় ছিলো, যখন আমরা কোরবানির পশুর জন্য পাশর্^বর্তী দেশ ভারত বা মায়ানমারের ওপর কিছুমাত্রায় নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু বর্তমান বছরগুলোতে সরকারি উদ্যোগের ফলে দেশের প্রাণিসম্পদক্ষেত্রে বিশেষ করে গবাদি পশুর সংরক্ষণ, উৎপাদন, সরবরাহ নিশ্চিতকরা, রোগবালাই দমন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলস্বরূপ কোরবানির সময় চাহিদার চেয়ে বেশিসংখ্যক পশু বাজারে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে গত এপ্রিল মাসে জানা যায়, গেলবছর কোরবানির ইদকে কেন্দ্রকরে দেশের খামারিরা প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ পশু প্রস্তুত করেন, যার মধ্যে ২২ লাখ পশু অবিক্রিত থেকে যায়। এবছর প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ পশু প্রস্তুত থাকবে, যা দেশে কোরবানির চাহিদার চেয়ে বেশি।
আবার, খুলনা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডাঃ মো: শরিফুল ইসলাম জানান, আসন্ন ইদ উল আযহায় জেলায় কোরবাণির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা এক লাখ ৩৪ হাজার চারশত ৪৩টি, যার বিপরীতে জেলায় কোরবানিযোগ্য পশুর প্রাপ্যতা বা মজুদ রয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার দুইশত ৭৮টি। এর মধ্যে ৬৬ হাজার নয়শত ৫৭টি গরু, ছাগল ৭৪ হাজার তিনশত ৬৪ টি, ভেড়া ১৪ হাজার আটশত ৩৪টি এবং অন্যান্য একশত ২৩টি পশু মজুদ রয়েছে। অর্থাৎ ইদে চাহিদার চেয়ে জেলায় ২১ হাজার আটশত ৩৫টি পশু উদ্বৃত্ত আছে। ফলে, খুলনাতে কোরবাণির পশুর সংকট হওয়ার কোন কারণ নেই।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ি, দেশীয় উৎস থেকে কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণের তাগিদ, আধুনিক হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রযুক্তির প্রয়োগ ও হৃষ্টপুষ্টকরণ খামারের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ঘটায় আমদানি-নির্ভর কোরবানির পশুর বাজারের পরিবর্তে দেশ আজ এখাতে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। গত ঈদ উল আযহার সময় দেশে এক কোটি চার হাজার গবাদি পশু কোরবানি হওয়ায় কোরবানির পশুর বাজারে প্রায় ৬০ হাজার তিনশত ৬৬ কোটি টাকা লেনদেন হয় যার সিংহভাগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবকালে ২০২২ সালের ঈদ উল-আযহা উপলক্ষ্যে প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু বিক্রি নিশ্চিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতায় অনলাইন প্লাটফর্মের আওতায় চার হাজার দুইশত ৩১ কোটি টাকা মূল্যের গবাদিপশু বিক্রি হয়।
নূন্যতম প্রাপ্যতার ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে মাংস উৎপাদিত হয়েছে মোট ৮৭.১০ লাখ মেট্রিক টন এবং মাংসের প্রাপ্যতা বেড়ে ১৩৭.৩৮ গ্রাম/দিন/জন এ উন্নীত হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে কোরবানির জন্য গবাদিপশু আমদানির কোন প্রয়োজন হয়নি। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে খামারিরা আগের তুলনায় গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণে বেশ উৎসাহিত হচ্ছে। গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, ব্রাহমা জাতের মাংস উৎপাদনক্ষম গরু সংযোজন ও সম্প্রসারণ এবং ব্যাপকহারে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণের মাধ্যমে দেশের চাহিদা শতভাগ পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করার সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। বিগত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৮৫ শতাংশ, প্রবৃদ্ধির হার ৩.২৩ শতাংশ ও চলতি মূল্যে জিডিপি’র আকার ৭৩ হাজার পাঁচশত ৭১ কোটি টাকা। কৃষিজ জিডিপি’তে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৫২ শতাংশ (বিবিএস, ২০২৩)। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ প্রত্যক্ষ এবং ৫০ শতাংশ পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল।
দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ২০৪১ সালের মধ্যে গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল এবং টেকসই জাত উন্নয়নের মাধ্যমে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে কাংখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সর্বোপরি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি, পিপিপি এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
দেশীয় গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে সমগ্র দেশে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মোট চার হাজার চারশত ৬৪টির বেশি কৃত্রিম প্রজনন উপকেন্দ্র/পয়েন্ট স্থাপনের মাধ্যমে দেশব্যাপী কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে ২০২২- ২০২৩ অর্থবছরে কৃত্রিম প্রজননকৃত গাভীর সংখ্যা ৪২ লাখ ৪৫ হাজার। কৃত্রিম প্রজননকৃত এ সকল গাভী হতে ১৬ লাখ ৫৩ হাজার সংকর জাতের বাছুর জন্ম নিয়েছে।
গবাদিপশুর রোগের প্রকোপ প্রতিরোধে চিকিৎসা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সারাদেশে প্রায় এককোটি ২৫ লাখ গবাদিপশুর চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে, যার ফলে দেশের প্রাণিস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে উৎপাদিত গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির ১৭টি রোগের প্রায় ৩২.৮৬৭ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে, যা দিয়ে সারাদেশের প্রাণিস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন কেন্দ্রীয় প্রাণিপুষ্টি গবেষণাগার থেকে পশুখাদ্য বিশ্লেষণ বিশেষ করে পশুখাদ্যে আর্দ্রতা, আমিষ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ক্যালরির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বিশ্লেষণকৃত পশুখাদ্যের নমুনার সংখ্যা ছিল চার হাজার ছয়শত ১৫টি এবং বিশ্লেষণকৃত পুষ্টি উপাদানের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার সাতশত ৩২টি। পশুখাদ্যে উপকরণ, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত পশুখাদ্যের ফিড এডিটিভস এর গুণগত মাননিয়ন্ত্রণ এবং পুষ্টিমান নিশ্চিতকল্পে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণ ও প্রাণিজাত খাদ্যের মাননিয়ন্ত্রণ গবেষণাগারের কার্যক্রম চালমান আছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরাধীন খামারসমূহে গরুর ৮৬৩টি বাছুর, ১৬৭২ টি ছাগলের বাচ্চা এবং ৬৫টি মহিষের বাচ্চা উৎপাদিত হয়েছে। সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামার হতে ৮৬৪টি প্রজনন পাঁঠা বিতরণ করা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদের কাঙ্খিত ও সহনশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১৩টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এ সকল প্রকল্পের আওতায় প্রাণিজ আমিষের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করার পাশাপাশি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাজার ব্যবস্থা জোরদারকরণ, প্রাণিজাত পণ্যের মূল্য সংযোজন এবং পশু বীমা চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ দুধ, মাংস ও ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি মেধাবী জাতি গঠনে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই উন্নত দেশে পরিণত হবে।
লেখক: মোঃ আতিকুর রহমান মুফতি, সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা।