দেশে বৈষম্য সৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা দায়ী বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। গবেষকরা খানা জরিপের তথ্যের বাইরে গিয়ে এ বিষয়ে গবেষণা না করায় প্রকৃত চিত্র উঠছে না বলে মত দেন। তিনি বলেন, ‘বৈষম্য’ শব্দটি খুবই অপ্রয়োজনীয় মনে করি। কারণ, এটি আসলে একটি লক্ষণ। বৈষম্যের প্রকৃতি বুঝতে লক্ষণের বাইরে গিয়ে উৎসের দিকে তাকাতে হবে। বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে অন্যায্য সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে, যা সময়ের সাথে সাথে বিকশিত, রূপান্তরিত এবং আরও জোরালো হচ্ছে।
আজ শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) উদ্যোগে আয়োজিত এবিসিডি সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
রেহমান সোবহান বলেন, এক সময় দেশের নির্বাচনব্যবস্থা এমন একটা রূপ পেয়েছিল, যেখানে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ঊচ্চ লাভজনক হয়ে উঠেছিল। খুব সহজেই সংসদ সদস্য হতে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করতে রাজি ছিলেন অনেকে। এ ব্যবস্থা রাজনীতির স্বরূপকেও প্রভাবিত করে। মূল রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক সংগঠন হয়ে পড়েছে, যেখানে সব ক্ষমতা দলের নেতৃত্ব পর্যায়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত এ সমস্যা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়েছে। ধীরে ধীরে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ব্যবসায়ীদের তোষণের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের মুষ্টিমেয় ব্যক্তি উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছে।
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি বেড়েছে, প্রশাসনে রাজনীতি ঢুকেছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হারিয়েছে, আইন প্রয়োগের অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার হয়েছে এবং সর্বোপরি সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছিল। সবশেষ তিনটি সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। সংসদ ছিল শুধু আইন প্রণয়ন করতে। অতিরিক্ত সময় কাটানোর সংসদ সদস্যদের কিছু না কিছু উপায় খুঁজে বের করা দরকার ছিল। তারা দুইটি পথ বেছে নিয়েছিলেন। প্রথমত- ব্যবসা, দ্বিতীয়ত- নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় জমিদার হয়ে ওঠা।
রেহমান সোবহান বলেন, সংসদ সদস্যরা ক্রমে স্থানীয় সরকারের এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের কাজকে নিজেদের করে নিয়েছিলেন। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বড় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। জমিদারি দখল করতে তারা একে অপরকে রক্ত ঝরাতেও দ্বিধা করতেন না। উপজেলা চেয়ারম্যানরা বুঝেছিলেন, যদি তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে না পারেন, তবে তার লাভ নেই। এই সমস্যা সংসদ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যবসায় অংশগ্রহণ করছিলেন।
দেশের প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ অবশ্য স্বীকার করেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকার পরও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নতি হয়েছে। আবার সমাজে আয়বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। দারিদ্রের হার ৫৭ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নেমেছে। এছাড়া পুষ্টি, শিশু মৃত্যুহার, বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের বছর, স্যানিটেশন, জ্বালানি, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, বাসস্থান ইত্যাদি সূচকেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। কীভাবে এমন খারাপ শাসন এবং অসমতাপূর্ণ সমাজের মধ্যে দারিদ্র্যের এতটা হ্রাস এবং মানব উন্নয়নে এতটা অগ্রগতি ঘটতে পারে- তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে দেশের সঠিক ও টেকসই উন্নয়ন হয়নি এমন ইঙ্গিত করে রেহমান সোবহান বলেন, অনেকে হয়তো সত্তর ও আশির দশকে কোরিয়ার অভিজ্ঞতা ভুলে গেছেন, যেখানে অর্থনীতির প্রধান কাঠামোগত পরিবর্তন আনে, শ্রমঘন শিল্প থেকে অনেক উন্নত স্তরের শিল্পায়নে রূপান্তর করে। স্টিল উৎপাদন এবং পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়, যেখানে বিশ্বব্যাংকের বিপক্ষে গিয়ে তারা স্টিল শিল্প স্থাপন করতে শুরু করেছিল। অবশেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পোহাং স্টিল মিলটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং দক্ষ শিল্পে পরিণত হয়েছিল। সেই সময় এটি যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল করপোরেশনকে অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শিল্প ছিল স্টিল। সিঙ্গাপুর বা তাইওয়ানের উদাহরণও দেখা যেতে পারে। অথচ বাংলাদেশে জাতীয়করণের কথা বললে, এখন কেউ এটা ভালো হবে বলে মত দেবে না। এ ক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ নেই।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। এছাড়াও দেশ–বিদেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা উপস্থিত ছিলেন। আজ শনিবার থেকে শুরু হওয়া বিআইডিএসের এই সম্মেলন আগামী মঙ্গলবার শেষ হবে।