বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আলাদা সচিবালয় করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। তাই এই স্বাধীনতা নিশ্চিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করা হবে। এ জন্য শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
সারাদেশে অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে শনিবার সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে দেওয়া অভিভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। এতে প্রায় ২ হাজার বিচারক অংশ নেন।প্রধান বিচারপতি তাঁর লিখিত ৪৮ মিনিটের বক্তব্যে বিচার বিভাগের নানা অসংগতি ও সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জাতীয় দুর্বিপাক থেকে উত্তরণের পর জনমুখী আইন ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো বিনির্মাণে করণীয় সম্পর্কে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। প্রস্তাবিত রোডম্যাপে রয়েছে– সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানো, শক্তিশালী আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, বিচারকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন, মাজদার হোসেন মামলার রায় পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, মামলাজট কমানো, ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, বিচারকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে দুর্নীতি বন্ধ করতে জিরো টলারেন্স ঘোষণা, বিচারাঙ্গন থেকে দুর্নীতি বিলোপ করা। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট হয়েছে, তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।’
বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় ছাড়া দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১৭ বছর আগে বিচার বিভাগ পৃথক হলেও এখানে চলছে দ্বৈতশাসন। এ কারণে বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। বিচার বিভাগ পৃথক সচিবালয়ে না হলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বিচারকদের পদায়নের জন্য পৃথক নীতিমালা করা হবে।’তিনি বলেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ, রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। এ জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।প্রধান বিচারপতি বলেন, জেলা জজ ও বিচারকদের দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হলে এটি তার সার্ভিসে ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা হবে। কারণ বিচার বিভাগে কোনো ব্যক্তির দুর্নীতি পুরো বিচার বিভাগের দুর্নাম হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে বিভিন্ন শাখায় দুর্নীতি-অনিয়ম ছেয়ে গেছে। এটি এখন আর বরদাশত করা হবে না।বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে মন্তব্য করে সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিচার বিভাগের দুর্নাম করা হয়েছে।
মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা খুবই কম জানিয়ে তিনি বলেন, ৪২ লাখ মামলার জট রয়েছে। মুদ্রার ওই পিঠে রয়েছে বিচারক সংকট। মাত্র ২ হাজার বিচারক দিয়ে এটি সম্ভব নয়। দক্ষ জনবল নিয়োগ জরুরি।সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা তত দিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যত দিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটিই হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। অন্যান্য দেশে অনুসৃত আধুনিক পদ্ধতিগুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি কলোজিয়াম ব্যবস্থা চালু করতে সচেষ্ট হওয়ার কথাও জানান প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানের জন্য এরই মধ্যে ১১১ বার সময় নেওয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটির প্রধান আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও অধস্তন আদালতের বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এমন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে মানুষ ন্যায়বিচার পায়। গায়েবি মামলা দিয়ে মানুষকে অযথা হয়রানি এই অন্তর্বর্তী সরকার সমর্থন করে না। ঢালাওভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিচারকদের দেখতে হবে, অযথা নাগরিকরা যেন হয়রানি না হয়। বিচার বিভাগ থেকে যেন কোনো অবিচার না হয়।অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, বিগত সময়ে যেসব বিচারক ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে মানুষের অধিকার হরণে ভূমিকা পালন করেছেন, তারা এখনও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছেন