চলমান মহামারি সত্ত্বেও ২০২০ সালে যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে পালিয়ে বাঁচা মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ কোটি ২৪ লাখে। এটি ২০১৯ সালের রেকর্ড ৭ কোটি ৯৫ লাখের চেয়েও ৪ শতাংশ বেশি।
শুক্রবার (১৮ জুন) জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বার্ষিক গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্টে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়।
জেনেভা থেকে প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে বিশ্ব নেতাদের প্রতি সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে ক্রমবর্ধমান বাস্তুচ্যুতির প্রায় এক দশক ধরে চলমান প্রবণতা বন্ধ ও এর বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি করতে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য তাদের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
রিপোর্টে ২০২০ সালের শেষে বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে আছে ইউএনএইচসিআর-এর ম্যান্ডেটের অধীন ২ কোটি ৭ লাখ শরণার্থী, ৫ কোটি ৭০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী এবং বিভিন্ন দেশে বাস্তুচ্যুত ৩৯ লাখ ভেনেজুয়েলান। এছাড়া আরও ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ তাদের নিজ দেশের ভেতরে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় ছিল। এর সঙ্গে আছে ৪১ লাখ আশ্রয়প্রার্থী। মহামারি ও বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতির আহ্বানের পরেও সংঘাতের কারণে যে মানুষের গৃহহীন হওয়া থামেনি, এই সংখ্যাগুলো তারই প্রমাণ।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, এগুলো শুধুই সংখ্যা নয়। এদের মধ্যে প্রত্যেকটি মানুষের রয়েছে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা, সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া এবং যন্ত্রণার গল্প। শুধু মানবিক সাহায্য নয়, তাদের দুর্দশার সমাধানে আমাদের মনযোগ ও যথাযথ সহায়তা দিতে হবে।
‘১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন ও গ্লোবাল কম্প্যাক্ট অন রিফিউজিস (শরণার্থীদের জন্য বৈশ্বিক সংহতি)-এর মাধ্যমে আমরা বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থীদের সাহায্যে আইনি কাঠামো ও অন্যান্য উপায় পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন অনেক বেশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তাহলেই বাস্তুচ্যুতির মূল কারণ সংঘাত ও নিপীড়ন কমানো যাবে। ’
বল প্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মানুষদের ৪২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তারা স্পষ্টতই অধিকতর ঝুঁকিতে থাকে, বিশেষ করে যদি কোনো একটি সংকট বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। ইউএনএইচসিআর-এর নতুন তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে মোট ১০ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে, যারা জন্ম থেকেই শরণার্থী। তাদের মধ্যে অনেকেই আগামী বছরগুলোতেও শরণার্থী হয়েই থাকবে।
২০২০ সালে যখন চলমান মহামারি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল, তখন ১৬০টিরও বেশি দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছিল, এর মধ্যে ৯৯টি দেশ সুরক্ষার খোঁজে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্যও তাদের সীমান্ত উন্মুক্ত করেনি। এমনটাই উঠে এসেছে ইউএনএইচসিআর-এর গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্টে। তবুও কিছু দেশ মহামারি মোকাবিলার পাশাপাশি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, আর উন্নত কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল। যেমন, সীমান্তে মেডিক্যাল স্ক্রিনিং, সীমান্ত অতিক্রমের পর স্বাস্থ্য সনদ (হেলথ সার্টিফিকেট) কিংবা সাময়িক কোয়ারেন্টিন, সহজতর নিবন্ধন প্রক্রিয়া, দূর থেকে ইন্টারভিউ নেওয়া ইত্যাদি।
যখন একদিকে কিছু মানুষ পালাতে গিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হচ্ছিল, তখন লাখ লাখ মানুষ নিজ দেশের ভেতরেই হচ্ছিল বাস্তুচ্যুত। এই অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষদের সংখ্যা আগের চেয়ে আরও ২৩ লাখ বেড়েছে, যারা মূলত ইথিওপিয়া, সুদান, সাহেল অঞ্চলের দেশগুলো, মোজাম্বিক, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও কলম্বিয়ার বিভিন্ন সংকটের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
পুরো ২০২০ সাল জুড়ে প্রায় ৩২ লাখ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ও মাত্র ২ লাখ ৫১ হাজার শরণার্থী নিজ বাড়িতে ফিরতে পেরেছে। এই সংখ্যা ২০১৯-এর তুলনায় যথাক্রমে ৪০ ও ২১ শতাংশ কম। প্রায় ৩৩ হাজার ৮শ শরণার্থী তাদের আশ্রয় প্রদানকারী দেশে ন্যাচারালাইজড হয়েছে। তৃতীয় কোনো দেশে শরণার্থীদের পুনর্বাসন অনেক কমে গেছে, গত বছরে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ হাজার ৪শ জন। এটি গত ২০ বছরে সর্বনিম্ন পুনর্বাসনের স্থান কমে যাওয়া ও কোভিড-১৯ এর ফলাফল এটি।
ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, এই সংকটগুলোর সমাধানের জন্য বৈশ্বিক নেতাদের ও প্রভাবশালীদের তাদের মতপার্থক্য, রাজনৈতিক অহংকার দূরে রাখতে হবে। সংঘাত প্রতিরোধ ও সমাধান এবং মানুষের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রাখাটাই বরং তাদের উচিত এই মুহূর্তে।