মানুষ গাছের ওপর নির্ভরশীল আদিকাল থেকেই। গাছের উপর নির্ভরশীলতা থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ এককালে প্রচুর পরিমানে গাছের পূজো করতো। বিশেষ করে বট, পিপুল, নিম সহ বিভিন্ন গাছের পূজা করার রীতি চালু ছিল বহুকাল আগে থেকেই।
সুন্দরবনকে এই অঞ্চলের বৃক্ষবিস্ময় বলা হয়। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বা উষ্ণমণ্ডলীয় বনাঞ্চল অবস্থিত এখানে। শুধু আয়তনের দিক থেকে নয় বরং বিশাল বনজ সম্পদ এবং এই সম্পদ আহরণের দিক থেকেও সুন্দরবন অনন্য হিসেবে বিবেচিত।
সুন্দরবনের নামকরণের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে নানান মত প্রচলিত। একটি মত হল, বনটি দেখতে সুন্দর তাই সুন্দরবন। আবার অনেকের মতে নামটি সমুদ্রবনের অপভ্রংশও হতে পারে। সমুদ্র তীরের বন থেকে সমুদ্রবন, সেখান থেকে সুন্দরবন।
আবার আরেকটি মত হল নামটি এসেছে চন্দ্রদ্বীপ বন থেকে। খুলনার বাকেরগঞ্জের উত্তরাঞ্চলে আদিলপুরে প্রাপ্ত তাম্রলপিতে এই নাম পাওয়া গিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- সুন্দরবন চন্দ্রদ্বীপের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত। এটি চাঁদের সন্তান ও জোয়ারের জলে সিক্ত। এর নাম চন্দ্রদ্বীপ বন।
তবে বর্তমানে মনে করা হয় নামটি এসেছে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় বৃক্ষ ‘সুন্দরী গাছ’ থেকে। পূর্বে সুন্দরী গাছই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ছিল এখানে।
শুধু সুন্দরবনের সুন্দরী গাছই নয়, রয়েছে শত শত প্রজাতির হাজার রকমের গাছ। গঙ্গা নদীর অববাহিকায় প্রায় দশ লাখ হেক্টর এলাকা জুড়ে পুরো সুন্দরবন এলাকা অবস্থিত।
বাংলাদেশের দক্ষিণে-পশ্চিমে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পূর্বে এর অবস্থান। বাংলাদেশের অংশে পড়েছে পুরো বনের বাষট্টি শতাংশ। এই অংশের গাছপালা এই দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রাখায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন এর হিসেব মতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। সুন্দরবনের বাতাস, জল ও মাটি সবই লবণাক্ত। যে কারণে এখানকার গাছপালাও বিচিত্র।
পৃথিবীর অন্যান্য ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের গাছপালা থেকে এই অঞ্চলের গাছপালার বিশেষত্ব হল, এখানকার প্রায় সব গাছই লবণ সহ্য করতে পারে।
দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল, এই গাছগুলো নরম কাদার ওপর জন্মায়।
তৃতীয়ত, এই সকল গাছ প্রবল হাওয়া এবং প্রচণ্ড স্রোতে অসংখ্য শিকড়ের সাহায্যে এই নরম মাটির ওপর সহজেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। জোয়ারের পানিতে গাছের গোঁড়া সবসময় ধুয়ে গেলেও গাছের কোনো ক্ষতি হয়না। বাতাস থেকে অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প নেওয়ার জন্য এই গাছেদের শূলের মতো সূচালো শ্বাসমূল থাকে। এদের মধ্যে বাইন, কেউড়া, সুন্দরী ও পশুর গাছের শ্বাসমূল স্পষ্ট চোখে পড়ে। খলসী, তোরা ও ফলো বাইন গাছে লবণ ত্যাগ করার বিশেষ গ্রন্থি থাকে। গর্জন, গেওয়া ও গরান গাছে রণপার মতো অসংখ্য ঠেসমূল দেখা যায়। এসব গাছের শিকড়গুলো জলের ধাক্কা সামলাতে ও শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে গাছকে সাহায্য করে।
লবণাক্ততার পরিমাণ যেখানে একটু কম সেখানে সুন্দরী, গর্জন ও কাঁকড়া গাছ ভালো জন্মায়। বিশেষ করে যেখানে নদীর জল মিষ্টি পানি নিয়ে আসে ও বেশি পলি জন্মায় সেখানে সুন্দরী গাছ খুব বেশি সংখ্যায় জন্মায়। গেওয়া ও গরান জন্মায় বেশি লবণাক্ত জমিতে। হেঁতাল জন্মায় অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের গাছপালা থেকে সুন্দরবনের গাছপালার এমন অদ্ভুত ও বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এই বনকে এ অঞ্চলের বিস্ময় বলা হয়।
তবে গাছগুলো টিকে থাকার দিক থেকে অন্য অঞ্চলের গাছ থেকে শুধু যে পৃথক তা নয় বরং ফল ও পাতার দিক থেকেও এর ভিন্নতা দৃশ্যমান। সুন্দরবনের প্রায় সবখানেই গর্জন গাছের দেখা।মেলে। এর পাতা রাবার গাছের পাতার মতো পুরু। ফুল ছোট, আর ফল হয় বকফুল কিংবা সজনের ফলের মতো লম্বাটে। কাঠ লালচে ধূসর বর্ণের। তবে এর কাঠ খুব টেকসই নয়। গর্জন গাছের পাতার সাথে অনেকটা মিল আছে কাঁকড়া গাছের। এ গাছের ফুলের বৃন্ত লাল কাঁকড়ার পায়ের মতো দেখায় বলে একে কাঁকড়া গাছ বলা হয়ে থাকে।
সুন্দরবনের গাছগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল সুন্দরী গাছ। সুন্দরীর পাতা ছোট, লবঙ্গের পাতার অনুরূপ আকারবিশিষ্ট। পাতার পৃষ্ঠভাগ মসৃণ। এর নিচের অংশ ধূসর। পাতা দেখতে দৃষ্টি সুখকর। সুন্দরীর ফুলও আকারে কিছুটা ছোট ও হলুদ বর্ণের। সুন্দরী গাছ লম্বায় ১০-২৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক সুন্দরী দেখতে অনেকটা জাম গাছের মতো। সুন্দরীর গুড়ির বেড় ২০-২৫ সেন্টিমিটারের মতো হয়ে থাকে। কাঠ গাঢ় লাল এবং শক্ত। এর কাঠ খুবই মূল্যবান। তবে পূর্বের তুলনায় সুন্দরবনে এই গাছ প্রায় ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। ‘আগা মরা’ রোগের কারণে এই গাছ কমে যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। অবাধে চোরাচালান কিংবা প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে ক্রমশই কমছে সুন্দরী গাছ।
আবার সবচেয়ে লবণাক্ত লবণাক্ত জমিতে জন্মায় গেওয়া ও গরাণ। গেওয়া অনেকটা খাড়া উঠে যায়। এই গাছ দূর্বল ও এর কাঠ হালকা। গাছের ভিতরের অংশ লালচে। গরান গাছ চিকন এবং খুবই মজবুত এর কাঠ। প্রায় ৩-৪ মিটার উঁচু হয় একেকটি গাছ। গরাণ মূলত ঝাড়বিশিষ্ট গাছ। একেক ঝাড়ে ৭-৮ টি গাছ থাকে।
এছাড়া সুন্দরবনে দেখা মেলে হেঁতাল গাছের। যা লবণাক্ত জমিতে কমই জন্মায়। এই গাছ জন্মায় উঁচু জমিতে, দেখতে অনেকটা বড় খেজুর গাছের মতো। এক জায়গায় অনেক হেঁতাল ঝাড় দেখা যায়। হেঁতাল দৈর্ঘ্যে ৫-৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। হেঁতালের গাছের আশে পাশে বাইন গাছও দেখা যায়। তবে নতুন পলি জমে যে ভূখণ্ড জেগে ওঠে তাতে বাইনের বন বেশি গড়ে উঠতে দেখা যায়। বাইন বেশ বড় গাছ, এর আয়ুকালও বেশ দীর্ঘ। ভালো তক্তা হয় এর কাঠে।
বাইনের মতো পশুরও বৃহৎ গাছ। পশুরের পাতা অনেকটা কাঁঠালের পাতার মতো। আবার ধুতুল গাছও অনেকটা পশুর গাছের মতো দেখতে। তবে সুন্দরী গাছের কাঠের পরে পশুর এবং ধুতুল গাছের কাঠের চাহিদা রয়েছে।
সুন্দরবনের অন্যসব গাছের মতো কেওড়া গাছ মানুষের কাজে খুব একটা না লাগলেও সুন্দরবনের বানর এবং হরিণ অনেকাংশে এই গাছের ওপর নির্ভরশীল। নদী ও খালের ধারে এই গাছ জন্মায়। এর ফলের স্বাদ টক।
সুন্দরবনে হেঁতাল ঝাড় ছাড়াও পরশ, হেদো এবং গোলপাতা ঝাড় এই বনের একটি বিস্ময় বলা যায়। সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আস্তানা এই গাছসমূহের ঝাড়গুলো। পরশ গাছের পাতা গোল। ফুল হলুদ রঙের। এছাড়া চর এলাকার নদীর ধারে ওরাধান, ঝাও বনলেবুর দেখা পাওয়া যায়।
সুন্দরবনের পরিচিত আরেকটি গাছ হল গোলপাতা। নারকেলজাতীয় এই গাছটি মাটির ওপরে মুলাকৃতির কাণ্ড থেকে নারিকেল বা তাল পাতার মতো সরাসরি বেরিয়ে আসে। শাখাহীন এই গাছের ফল একটা আরেকটা পাশাপাশি লেগে থাকে যার আকৃতি হয় বিশাল। এর ফল খেতে খুবই সুস্বাদু, কিছুটা তালের শ্বাসের মতো। এই গাছের পাতা দিয়ে গ্রামের গোলপাতার ঘরের চাল ছাওয়া হয়। এক সময় ব্যাপকভাবে এর চাহিদা ছিলো। সুন্দরবন থেকে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমানে এই গাছ নিধন হচ্ছে যে কারণে এই গাছ হুমকির মুখে রয়েছে।
গোলপাতা ছাড়াও অন্য শত শত রকমের গাছ রয়েছে এখান৩ যেগুলোর প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মনুষ্যসৃষ্টি বিভিন্ন সমস্যার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে।
সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ না হলে বিপর্যস্ত হবে এ অঞ্চলের প্রকৃতি। তাই সুন্দরবনের প্রত্যেকটি গাছের রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি এবং এ দায়িত্ব আমাদের সকলের।