সব আলো নিভিয়ে রাতের অন্ধকারে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে চলে যায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বাহিনী। এমনকি এ বিষয়ে আফগান কর্মকর্তাদেরও কিছু জানায়নি তারা। ঘাঁটির নতুন আফগান কমান্ডার জেনারেল আসাদুল্লাহ কোহিস্তানি বিবিসি’কে জানিয়েছেন, গত শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ৩টার দিকে বাগরাম ছেড়ে যায় মার্কিন সেনারা। এর কয়েক ঘণ্টা পর বিষয়টি জানতে পারে আফগান বাহিনী।

বাগরাম শুধু সামরিক বিমানঘাঁটিই নয়, এটি একটি কারাগারও। সেখানে বর্তমানে পাঁচ হাজারের বেশ তালেবান সদস্য বন্দি রয়েছে। এ অবস্থায় ঘাঁটি পুরোপুরি অরক্ষিত রেখে কাউকে কিছু না জানিয়ে মার্কিন বাহিনী হুট করে বিদায় নেয়ায় বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, তালেবান যোদ্ধারা দ্রুত বাগরামের দিকে এগোচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।

গত সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জেনারেল কোহিস্তানিও স্বীকার করেছেন, তালেবান খুব শিগগিরই বাগরামে আক্রমণ করবে বলে ধরে নিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আশপাশের গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের আনাগোনা শুরু হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এ কর্মকর্তা বলেন, যদি মার্কিনিদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করি, তাহলে সেখানে বিশাল ফারাক। কিন্তু আমাদের সক্ষমতার ভিত্তিতে আমরা যথাসম্ভব নিরাপত্তা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।



গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা আফগানিস্তানে নিজেদের প্রধান ঘাঁটি বাগরাম পুরোপুরি খালি করে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুসারে, নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সমাপ্তি টেনে আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেবে যুক্তরাষ্ট্রের সব সেনা।

জেনারেল কোহিস্তানি জানিয়েছেন, মার্কিন বাহিনী বাগরামে প্রায় ৩৫ লাখ বস্তু ফেলে গেছে। এর মধ্যে হাজার হাজার পানির বোতল, এনার্জি ড্রিংক, সেনাদের জন্য তৈরি বিশেষ ধরনের খাবার রয়েছে। মার্কিনিরা কয়েক হাজার বেসামরিক গাড়ি এবং শত শত সাঁজোয়া যানও রেখে গেছে, তবে সেগুলোর চাবি পাওয়া যায়নি।

আফগান কর্মকর্তার বরাতে বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, যাওয়ার সময় মার্কিন বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে গেছে এবং কিছু গোলাবারুদ ধ্বংস করেছে। সেখানে আফগান বাহিনীর জন্য অল্প কিছু গোলাবারুদ রেখে যাওয়া হয়েছে।

রাতের অন্ধকারে চুপিসারে বাগরাম ছাড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মার্কিন সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্র এপি’কে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রত্যাহার প্রক্রিয়ায় আফগান কর্মকর্তাদের সমন্বয় করা হয়েছে।

এপি জানায়, গত শুক্রবার রাতে মার্কিন বাহিনী বাগরাম ছাড়ার ২০ মিনিটের মধ্যে সেখানে ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দেয়া হয়, যার ফলে পুরো ঘাঁটি অন্ধকারে ডুবে যায়। এমন সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুটেরারা ব্যারিয়ার পেরিয়ে ঘাঁটির বিভিন্ন ভবনে ঢুকে লুটপাট চালায়।

মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আফগান বাহিনী। তবে সেটিকে তালেবানের হাত থেকে রক্ষার জন্য মার্কিনিদের মতো উন্নত অস্ত্রশস্ত্র তাদের কাছে নেই, সংখ্যায়ও তারা অনেক কম। জেনারেল কোহিস্তানি জানিয়েছেন, বাগরামে তার অধীনে হাজার তিনেক আফগান সেনা রয়েছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় আফগানিস্তানে নতুন করে ১০টি জেলার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দাবি করেছে তালেবান। গত সোমবারই দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে তালেবানের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে প্রতিবেশী দেশ তাজিকিস্তানে পালিয়ে জান বাঁচিয়েছেন প্রায় এক হাজার আফগান সেনা। এখন সৈন্য স্বল্পতায় ভোগা বাগরামে তালেবানের হামলা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

২০০১ সাল থেকে বাগরামে যুক্তরাষ্ট্রের এক লাখের বেশি সেনা দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের ঘিরে এলাকাটি অনেকটা ছোটখাটো আমেরিকান শহরে পরিণত হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল শপিং সেন্টার, ফাস্টফুডের দোকানও। কাবুল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই ঘাঁটি থেকেই দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে সকল বিমান হামলা ও কৌশলগত কার্যক্রম পরিচালনা করত মার্কিন সেনারা।

হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত বাগরামের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখলের পর সোভিয়েত সেনারাও সেটি ব্যবহার করেছিল। এখন অনেকেরই আশঙ্কা, ঘাঁটিটি তালেবান দখল করে নিলে সেটি তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বিজয় হবে।