সম্প্রতি হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনার মামলায় একের পর এক কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সবশেষ রোববার (১৮ এপ্রিল) সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেফতার করা হয়।
হেফাজত নেতাদের গ্রেফতার ইস্যুকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে নাশকতা করতে না পারে এজন্য রাজধানীসহ সারাদেশে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। বিশেষ করে মতিঝিল, পল্টন ও মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামসহ হেফাজত অধ্যুষিত এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ অবস্থান নিয়েছে।
এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন থানা ছাড়াও মসজিদ, মাদরাসা ও পাড়া-মহল্লায় পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে মামুনুলকে গ্রেফতারে পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। গ্রেফতারের আগে মোহাম্মদপুরে দুই শতাধিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা যায়, সকালে সব এসপি ও রেঞ্জের ডিআইজিকে স্ব-স্ব জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। কেউ যাতে কোনোভাবেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে, মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ডিএমপির একাধিক থানার ওসি জানান, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় পুলিশ সদস্য বাড়ানো হয়েছে। অনেক থানার প্রধান ফটকে ভারী অস্ত্রসহ পুলিশ সদস্যরা ডিউটি করছেন। তবে যেসব থানায় ভারী অস্ত্র বসানো হয়নি, তাদের প্রধান ফটকে অস্ত্রসহ লোকবল বাড়াতে বলা হয়েছে। তাছাড়া রাস্তায় বা পাড়া-মহল্লায় চেকপোস্টে পুলিশি তল্লাশির পাশাপাশি বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মসজিদ, মাদরাসায় পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশের কোনো সদস্য যাতে একা একা ডিউটি না করেন বা বাইরে একা না ঘোরাফেরা করেন সে বিষয় খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানান, আগে থেকেই জেলাজুড়ে বাড়তি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। টহল পুলিশ বাড়ানোর পাশাপাশি কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে তল্লাশি করা হচ্ছে। শুধু মামুনুল হকের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করেই এই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়নি। আগেই সতর্ক অবস্থানে থাকতে পুলিশ সদরদফতর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
এর আগে, দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা থেকে মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেফতার করা হয়। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরদারিতে ছিলেন।
গ্রেফতারের পর দুপুর পৌনে ২টার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. হারুন-অর-রশিদ।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের মোহাম্মদপুর থানার একটি ভাঙচুর ও নাশকতার মামলার তদন্ত চলছিল। তদন্তে হেফাজত নেতা মামুনুলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়ায় আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তা আপনারা সবাই জানেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি হারুন বলেন, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারীর ঘটনার পর থেকেই তিনি নজরদারিতে ছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে আপাতত মোহাম্মদপুর থানার মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
তাকে আদালতে হাজির করার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, আগামীকাল সোমবার (১৯ এপ্রিল) তাকে আদালতে হাজির করা হবে। তবে রিমান্ড চাওয়া হবে কি-না তা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করে হেফাজতে ইসলাম। মোদির বিরোধিতায় প্রথমে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভে সহিংসতা হয়। তার জেরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাণঘাতী সংঘাত হয়। ২৮ মার্চ হরতাল ডাকে হেফাজত, ওই হরতালকে ঘিরে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয় সারাদেশে।
এরপর গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার রয়েল রিসোর্টে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে ‘ঘেরাও’ করার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, মামুনুল এক নারীসহ আটক হয়েছেন। যদিও ওই নারীকে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করেন মামুনুল হক। ওইদিন সন্ধ্যায় রিসোর্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে স্থানীয় একটি মসজিদে নিয়ে যান হেফাজত নেতাকর্মীরা।
হেফাজতের নেতাকর্মীরা রিসোর্ট, স্থানীয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়, বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর এবং যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। এছাড়া তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে।
ওইদিন পুলিশের ওপর হামলা ও রিসোর্টে ভাঙচুরের অভিযোগে মামুনুল হকসহ ৮৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়। এছাড়া মামলায় ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামিও করা হয়।
এ মামলায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা ও রিসোর্টে ভাঙচুরের অভিযোগ এনে ৪১ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় মামুনুল হককে।
এছাড়া যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে আরেকটি মামলা করা হয়। এ মামলায় ৪২ জনের নাম উল্লেখ ও ২৫০-৩০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এ মামলায় হেফাজতে ইসলাম, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম উল্লেখ রয়েছে।