কিছু মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি সুখী হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে। ঝরনায় গান গাওয়া, বৃষ্টিতে নাচা বা এগুলোর চেয়েও আরও বেশি কিছু করা; যে ধরনের ব্যক্তিই আপনি হোন না কেন আপনার জানা প্রয়োজন সুখী হওয়া কেবল আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে তার সঙ্গেই জড়িত নয়। কারণ, সুখ বা সন্তুষ্টি সহজাত নয় বরং অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে তা অর্জন করা যায়। আপনি জীবনে আরও সুখী হতে বিজ্ঞান-সমর্থিত কিছু টিপস ফলো করতে পারেন।
বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দেওয়া
বন্ধুত্ব সব বয়সের মানুষের উপকার করে। কিন্তু জীবনের শেষের দিকে বন্ধুত্ব সুখের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়শই পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা কম সময় ব্যয় করে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, নতুন বন্ধুত্বের জন্য উন্মুক্ত থাকা পারিবারিক সম্পর্কের চেয়ে ভিন্ন সুবিধা প্রদান করতে পারে। এই ঐচ্ছিক বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো যে কোনো সময় শুরু বা শেষ হতে পারে, যা সম্পর্কগুলোকে আরও মজাদার কিংবা কম অপ্রীতিকর করে তোলে। বয়স্করা তাদের পরিপক্ক ব্যক্তিত্ব, উন্নত সামাজিক দক্ষতা, আনন্দভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বন্ধুত্ব করা সহজ করে তুলতে পারে। যাইহোক, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসম্পন্ন বন্ধুত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বাড়ায় এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। ধারাবাহিক গবেষণা প্রমাণিত হয় যে, প্রাপ্তবয়স্ক ও বৃদ্ধ বয়সে সুস্থতার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য বন্ধুত্ব পারিবারিক বন্ধনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি যদি এমন ব্যক্তি হোন যে, বন্ধুত্ব করা আপনার জন্য কঠিন মনে হয়; তবে ভাবনার কোনো কারণ নেই। আপনি বিকল্প পথে যেতে পারেন। যেমন- আপনি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের মতো বিস্ময়কর মুহূর্তগুলো সবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। এটি একটি খুবই ভাল উপায়, যা আপনাকে আপনার চারপাশের মানুষদেরকে কাছাকাছি অনুভব করতে সাহায্য করার পাশাপাশি আপনার কিছু ইতিবাচক আবেগকে অনুপ্রাণিত ও সুখী করবে।
অন্যের সুখে সুখ অনুভবের অভ্যাস করা
আমরা একে অন্যের বিপদাপদ, দুঃখ, কষ্ট, ক্লেশে সহানুভূতি, করুণা বা দয়া প্রকাশ করে থাকি। এটাকে সাধারণত সত্যিকার বন্ধুত্বের একটি সুপরিচিত ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়। সহানুভূতি বলতে বোঝায়- ‘শেয়ার্ড পেইন’, অর্থাৎ অন্যের কষ্টকর আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া ও ভাগাভাগি করে নেওয়া।
যে ব্যক্তি কষ্ট পাচ্ছে বা দুর্ভাগ্যের শিকার তার জন্য দুঃখ বা গভীর সমবেদনা প্রকাশ করা। যখন আমাদের বন্ধুদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তখন এই সহানুভূতি জীবনের কঠিন সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বা সংযোগ গড়ে তুলতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে।
ডেভিড রবসন একজন পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞান লেখক। সামাজিক জীবন নিয়ে লেখা তার ‘দ্য লজ অফ কানেকশন’ দুনিয়াব্যাপী একটি সাড়া জাগানো বই। তিনি নতুন একটি বিপরীত বিষয় উপস্থাপন করেছেন, যা তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত। কিন্তু ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা গুরুত্বপূর্ণ সহানুভূতির ক্ষেত্রে। আর এটি হচ্ছে ‘শেয়ারড হ্যাপিনেস’, অর্থাৎ অন্যের সুখে আনন্দিত হওয়া বা সুখ অনুভব করা।
তিনি বলছেন, ভালো সম্পর্কের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যদিও আমরা এ বিষয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। একাধিক গবেষণায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ডেভিড রবসন আরও বলেন, একজন ভালো বন্ধু হওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে বন্ধুর সুসংবাদে আন্তরিকভাবে প্রশংসা করা এবং এই সম্পর্কে আরও কিছু জানা। কিন্তু আপনি যদি খুব বেশি নিষ্ক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানান বা ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার বন্ধুর সাফল্যকে খাটো করে দেখেন; তবে ধরেই নিতে পারেন যে আপনার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবামূলক কিছু কাজ করা
বলাই বাহুল্য, কারও জন্য কিছু করলে নিজেকে পুরস্কৃত করার চেয়ে ভালো বোধ হয়। এ কারণে পরার্থপরতা সম্পর্কে যত বেশি জানবেন, ততই এটিকে একটি ভাল কাজ হিসেবে মনে হবে। এতে আপনি জীবনে বেশি সুখী হবেন। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ও বিষণ্ণতা উপশমের একটি শক্তিশালী উপায় হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় এমনটিই প্রমাণিত হয়েছে। ২০০২ সালে এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার সঙ্গে লড়াই করা ব্যক্তিদের সহায়তাকারী সহকর্মী স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যথার তীব্রতার হার হ্রাস পেয়েছে।
উপরন্তু, বিজ্ঞানীরা আরও দেখতে পান যে, প্রাণী ও ঘরের গাছপালার যত্ন নেওয়ার কাজ স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে, বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে। আর তাই স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা এখন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজকে ‘সামাজিক প্রেসক্রিপশন’ এর একটি কার্যকর রূপ হিসেবে পরামর্শ দিচ্ছেন। কারণ, এটি মানুষকে সমাজের সম্পদ ও কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ত করে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা আরও বলেন যে, শিল্পকলার ক্লাসে অংশগ্রহণ, সাইক্লিং গ্রুপে অর্ন্তভূক্ত ও খাবার বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মতো কার্যকলাপগুলোকে সুস্থ্যতার জন্য প্রেসক্রিপশন হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর এটি উল্লেখযোগ্যভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর চাপ কমাতে পারে। সামগ্রিকভাবে, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ মানুষের সামগ্রিক সুস্থতার উন্নতির জন্য একটি কার্যকরী ও উপকারী উপায় হতে পারে।
পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা
আমরা অতীতকে ভুলে যাই বা অনেক সময় ভুলে যেতে চেষ্টা করি। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, অতীত আপনাকে বর্তমান সময়ে দারুণভাবে সাহায্য করতে পারে এবং আপনাকে আরও বেশি সুখী করতে পারে। গবেষকরা দাবি করেন, আমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা মানসিকভাবে উপকারী হতে পারে। কারণ, প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার পারিবারিক গল্পগুলো ভবিষ্যত প্রজন্মকে অবগত করার ফলে তারা আরও বেশি উৎসাহ, সাহস, দৃঢ়তা ও ক্ষমতায়ন লাভ করে।
মেলবোর্নের সুইনবার্ন টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের এমিরিটাস অধ্যাপক সুসান এম মুর দেখতে পান যে, যারা তাদের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে আরও বেশি জানেন, তাদের সুখ ও সুস্থতার মাত্রা বেশি থাকে। আপনার পারিবারিক ইতিহাস গবেষণা করলে আপনার জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণের শক্তি, অনুভূতি, পৃথিবীতে আপনার অবস্থান সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৃতজ্ঞতার একটি দৃঢ় অনুভূতি তৈরি হতে পারে। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনার আজকের জীবন আপনার পূর্বসূরীদের সংগ্রাম ও দৃঢ়তার দ্বারা সম্ভব হয়েছে।
ভাল কাজের তালিকা করা
আশীর্বাদপুষ্ট কাজ মনে রাখা বা হিসেব করে রাখা একটি বহু পুরনো পরামর্শ। আমাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া তিনটি ইতিবাচক ঘটনার একটি তালিকা তৈরি করা আমাদের মন-মেজাজকে ভাল রাখতে পারে। এর মধ্যে থাকতে পারে- পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বা সন্তান নেওয়ার মতো জীবন বদলে দেওয়ার ঘটনা অথবা আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ ঘটনা; যেমন- হেঁটে বেড়ানোর সময় কোনো পুরনো বন্ধুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া বা সন্ধ্যার সুন্দর আলো উপভোগ করা।
গবেষকরা বলেন, আশীর্বাদপ্রাপ্ত কাজ বা ঘটনা মনে রাখা বা হিসেব করে রাখা আমাদের সামগ্রিক সুস্থতার প্রভূত উন্নতি করতে পারে ও আমাদেরকে আরও সুখী করে তুলতে পারে।
আনন্দদায়ক কাজের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা
ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ল্যাবে ইঁদুরদের ছোট ছোট ‘পারস্পেক্স’ গাড়ি চালানো শিখিয়েছেন। তারা লক্ষ্য করেছেন, ইঁদুররা দ্রুত এই দক্ষতা অর্জন করে ও উৎসাহের সঙ্গে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হয়। গবেষকরা আরও খেয়াল করেন যে, কিছু ইঁদুর উত্তেজিতভাবে ছোট ছোট লাফ দিচ্ছে; যেন তারা আনন্দের প্রত্যাশা উপভোগ করছে। এর ফলে গবেষণার একটি নতুন প্রশ্ন উদিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে – মজার প্রত্যাশা কি কার্যকলাপের মতোই ফলপ্রসূ হতে পারে?
আরেকটি পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা কিছু ইঁদুরকে পুরষ্কারের জন্য অপেক্ষা করার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, অন্যগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে তা দেওয়া হয়েছে। তারা দেখতে পান যে, যেগুলোকে পুরষ্কারের জন্য অপেক্ষা করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো আরও আশাবাদী ছিল।
গবেষকরা অনুমান করেন যে, এটি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তারা বলেন, মানুষ নিয়মিতভাবে আনন্দদায়ক কার্যকলাপ বা ঘটনাগুলো প্রত্যাশা করে উপকৃত হতে পারে। এটি তাদের মস্তিষ্ককে আরও আশাবাদী হওয়ার জন্য পুনরায় পরিকল্পনা করতে সাহায্য করতে পারে।
বেশি কিছু ভাববেন না
সুখী হওয়ার জন্য খুব বেশি কিছু করবেন না বা ভাববেন না বিষয়টি এই সুখী হওয়ার তালিকাতে দেখতে পেয়ে আপনি হয়তো অবাক হতে পারেন। কিন্তু গবেষণা বলে, সুখী হওয়ার বিষয়ে খুব বেশি উদ্বেগ থাকলে সুখ অনুভব করতে বাধা হতে পারে। বাস্তবতা বলে, একটি সুখকর ছবি দেখার আগে যে অভিজ্ঞতা মানুষকে আরও বেশি সুখের আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে; তা ছবি দেখার পর উচ্ছ্বসিত হওয়ার চেয়ে বেশি হতাশ করে। কারণ, প্রত্যাশা বাড়ানোর ফলে মানুষ হতাশা বোধ করতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে এমনটা হতে পারে, যখন কোনো বড় অনুষ্ঠান বা পার্টি আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত না হয়।
উপরন্তু, সুখের সন্ধান একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বাড়িয়ে দিতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলের মনোবিজ্ঞানী আইরিস মস একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি কমাতে আরও বেশি বাস্তববাদী মনোভাব গ্রহণ এবং জীবনের উত্থান-পতন মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
খুব বেশি ক্যাফেইন পান না করা
শীতের কনকনে ঠান্ডার সময়ে এক কাপ কফি আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে। কারণ, এটি দ্রুত রক্তপ্রবাহে মিশে যায় ও অ্যাডেনোসিনকে ছাড়িয়ে যায়। অ্যাডেনোসিন একটি রাসায়নিক, যা আমাদেরকে ক্লান্ত বোধ করায়। গবেষণায় দেখা যায়, ক্যাফেইনের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছ। এর মধ্যে রয়েছে- ক্যান্সার, হৃদরোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস, শারীরিক কর্মক্ষমতা উন্নত করা ও বিষণ্ণতা থেকে সুরক্ষা। তবে ক্যাফেইন গ্রহণের সময় নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শরীরে ক্যাফেইনের কার্যক্রম শুরু ও শেষ হতে সময়ের প্রয়োজন হয়।
বিজ্ঞানীরা ঘুমানোর আট ঘণ্টা ৪৮ মিনিট আগে শেষ ক্যাফেইন গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। একদিনে ৪০০ মিলিগ্রাম বা দুই থেকে তিন কাপ কফির অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যাফেইন গ্রহণ করলে ঘুমের ব্যাঘাত, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব ও উদ্বেগ হতে পারে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি