বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে রাশিয়ার। কিন্তু ইউক্রেনে সেটির স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কর্মদক্ষতা নিয়ে পশ্চিমা অনেক সামরিক বিশ্লেষক রীতিমতো বিস্মিত। পশ্চিমা এক বিশ্লেষক এই পরিস্থিতিকে ‘হতাশাজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন।
দেশটির সামরিক অগ্রগতি অনেকাংশে থমকে গেছে বলে মনে হচ্ছে এবং রাশিয়ার সামরিক বাহিনী যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা সামলে উঠতে পারবে কি না, কেউ কেউ সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।
চলতি সপ্তাহে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, রাশিয়ানরা স্পষ্টতই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এবং সম্ভবত দিনের শেষেও পারবে না। তাহলে ভুলটা কী? বিবিসির প্রতিরক্ষা প্রতিনিধি জোনাথন বিলে পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছেন ইউক্রেনে রাশিয়ার ভুলের ব্যাপারে।
ভুল অনুমান
রাশিয়া প্রথম যে ভুলটি করেছে সেটি হলো— প্রতিরোধের শক্তি এবং ইউক্রেনের নিজস্ব তুলনামূলক ছোট সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতাকে যথার্থ মূল্যায়ন না করা। রাশিয়ার বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যেখানে ইউক্রেনের এই ব্যয় মাত্র ৪ বিলিয়নের কিছু বেশি।
একই সময়ে রাশিয়া এবং অন্যান্য অনেকেই তাদের নিজেদের সামরিক শক্তির অতিরিক্ত মূল্যায়ন করেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য উচ্চাভিলাষী এক আধুনিকীকরণ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন এবং হয়তো নিজের প্রচারে বিশ্বাসও করতেন তিনি।
ব্রিটেনের জ্যেষ্ঠ একজন সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়ার বিনিয়োগের বেশিরভাগই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো নতুন অস্ত্র তৈরিসহ পারমাণবিক অস্ত্রাগার এবং অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয় করা হয়। রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ট্যাংক টি-১৪ আরমাটা তৈরি করেছে বলে ধারণা করা হয়। মস্কোর রেড স্কয়ারে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে এই অস্ত্র দেখা গেলেও যুদ্ধের ময়দানে অনুপস্থিত রয়েছে। রাশিয়া এখন পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধের মাঠে যেসব অস্ত্র মোতায়েন করেছে, তার মধ্যে রয়েছে পুরনো টি-৭২ ট্যাংক, সৈন্যবাহী সাঁজোয়া যান, কামান ও রকেট লঞ্চার।
আগ্রাসনের শুরুতে আকাশে পরিষ্কারভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল রাশিয়া। যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি সীমান্তে যে সৈন্য সমাবেশ করেছিল, তা ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর তুলনায় তিনগুণ বেশি দেখা গেছে। অনেক সামরিক বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন, হামলাকারী বাহিনী খুব দ্রুত ইউক্রেনের আকাশে নিজেদের দখল নিয়ে নেবে। কিন্তু তারা পারেনি। দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনও সক্ষম।
মস্কো হয়তো আশা করেছিল, তাদের বিশেষ বাহিনী যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। খুব দ্রুত তারা ফলাফল এনে দেবে। কিন্তু পশ্চিমা জ্যেষ্ঠ এক সামরিক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, রাশিয়া ভেবেছিল, তারা স্পেৎনাজ আর ভিডিভি প্যারাট্রুপারের মতো হালকা ইউনিট মোতায়েন করে ইউক্রেনের ছোটখাটো প্রতিরক্ষা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দেবে। তাতেই তাদের দখল চলে আসবে।
কিন্তু প্রথম কয়েকদিনে ইউক্রেনের কিয়েভের কাছাকাছি হোস্টোমেল বিমানবন্দরে রাশিয়ার হেলিকপ্টার হামলা ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে রাশিয়া তাদের পরিকল্পনা মতো সৈন্য, সরঞ্জাম অথবা রসদের সরবরাহ আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
বরং রসদ সরবরাহের জন্য রাশিয়াকে সড়ক পথের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এর ফলে সেখানে ব্যাপক যানজটের তৈরি হয়েছে। তাদের ওপর ইউক্রেনের সৈন্যরা সহজে অতর্কিতে হামলা চালাতে পারছে। অনেক ভারি সশস্ত্র যান সড়ক থেকে সরে গিয়ে উল্টো কাদায় আটকে পড়েছে।
উত্তর দিক থেকে কিয়েভ অভিমুখী রাশিয়ার যে লম্বা গাড়িবহর স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, সেটাও এখনো কিয়েভ ঘিরে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে দক্ষিণে, যেখানে তারা রেলপথ ব্যবহার করে সৈন্যদের জন্য রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে।
ব্রিটেশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বিবিসিকে বলেছেন, পুতিনের সৈন্যরা আসল মুহূর্তটি হারিয়ে ফেলেছে। ‘তারা এখন আটকে পড়েছে, গতি কমে গেছে এবং নিশ্চিতভাবে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
ক্ষয়ক্ষতি এবং ভঙ্গুর মনোবল
হামলা শুরুর পর থেকে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে রাশিয়া, যারা এখন যুদ্ধ করছে। কিন্তু এর মধ্যেই তারা প্রায় ১০ শতাংশ শক্তি হারিয়েছে। রাশিয়া অথবা ইউক্রেনের পক্ষে আসলে কতজন প্রাণ হারিয়েছে, তার নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য নেই। ইউক্রেন দাবি করেছে, তারা রাশিয়ার ১৪ হাজারের বেশি সৈন্য হত্যা করেছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, সেই সংখ্যাটা এর অর্ধেক হবে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার সৈন্যদের মনোবল যে কমে যাচ্ছে, তারও অনেক নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের খুবই মনোবল ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। আরেকজন কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়ার সৈন্যরা ‘ঠান্ডায় কাতর, পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধার্ত’, যেহেতু হামলা শুরুর আগে বেলারুশ ও রাশিয়াতেও তাদের অনেকদিন তুষারের মধ্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে ইতোমধ্যে নতুন করে সৈন্য মোতায়েনে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে রাশিয়া। এমনকি দেশের পূর্বাঞ্চল ও আর্মেনিয়া থেকে সংরক্ষিত সৈন্য আনতে বাধ্য হয়েছে মস্কো। পশ্চিমা কর্মকর্তারা মনে করেন, রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্যদের ওয়াগনার গ্রুপ এবং সিরিয়ার মতো দেশ থেকে শিগগিরই বিদেশি সৈন্যরাও এই যুদ্ধে অংশ নেবে।
ন্যাটোর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এর মানে হচ্ছে, তারা তলানি থেকেও এখন শক্তি কুড়ানোর চেষ্টা করছে।
রসদ ও সরঞ্জাম সরবরাহ
ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকেই মৌলিক বেশ কিছু বিষয় নিয়ে সমস্যায় পড়েছে রাশিয়া। সামরিক ক্ষেত্রে একটি পুরনো কথা চালু রয়েছে যে, অপেশাদাররা কৌশল নিয়ে কথা বলতে থাকে, যখন পেশাদাররা সরবরাহ নিয়ে চিন্তা করে। রাশিয়ার কর্মকাণ্ড দেখে ধারণা করা হচ্ছে, দেশটি এই ক্ষেত্রে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি।
সশস্ত্র গাড়ি বহরে তেল ফুরিয়ে গেছে, খাদ্য ও গুলি সংকটে ভুগছে। মাঝপথে নষ্ট গাড়ি ফেলে চলে গেছে রাশিয়ার সৈন্যরা। পরে সেগুলো টেনে নিয়ে গেছে ইউক্রেনের ট্রাক্টর।
পশ্চিমা কর্মকর্তাদের ধারণা, বেশ কয়েক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র সংকটে ভুগছে রাশিয়া। এর মধ্যে ৮৫০ থেকে ৯০০ কিলোমিটারের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে রাশিয়া, যার মধ্যে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের বিকল্প পাওয়া মুশকিল।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, নিজেদের যুদ্ধাস্ত্র সংকট কাটাতে চীনের সহায়তা চেয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ক্রমেই অস্ত্র পাচ্ছে ইউক্রেন, যা তাদের মনোবল দৃঢ় করে তুলছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় ৮০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
অ্যান্টি-ট্যাংক এবং বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবিত ‘কামিকাজি’ ড্রোন দেওয়া হচ্ছে ইউক্রেনকে। ছোট আকারের এই ড্রোন ঘাড়ের ব্যাগে করেই বহন করা যায়। সেগুলো শত্রুপক্ষের ওপর ছোট আকারের বিস্ফোরক নিয়ে আঘাত করতে পারে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন ‘তার নিষ্ঠুরতার মাত্রা দ্বিগুণ’ করে তুলতে পারেন। তারা বলছেন, পুতিনের কাছে এখনো এমন অনেক অস্ত্র রয়েছে, যা দিয়ে তিনি ইউক্রেনের শহরগুলোর ওপর দীর্ঘদিন ধরে গোলাবর্ষণ চালিয়ে যেতে পারেন।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, এসব সমস্যা সত্ত্বেও ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো নিরুৎসাহিত না হলে বরং আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারেন। তিনি হয়তো বিশ্বাস করেন, রাশিয়া সামরিকভাবে ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে পারবে। ইউক্রেনের সৈন্যরা কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলায় পশ্চিমা কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গোলাবারুদ ও সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে যথেষ্ট সরবরাহ না পেলে রাশিয়ার সৈন্যরা বড় ধরনের সংকটে পড়ে যাবে। যদিও যুদ্ধ শুরুর তুলনায় এখন ইউক্রেন অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু এখনো তাদের প্রতিকূলতা অনেক বেশি।
পিএসএন/এমঅাই