ঈদুল আজহা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গরু খামারিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন কোরবানির পশু প্রস্তুতিতে। খামারিরা বলছেন, তারা এই বছর লাভের আশা করছেন, যদি বাজার স্থিতিশীল থাকে। খামারগুলোতে রাসায়নিকমুক্ত, প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত খাদ্য এবং নিয়মিত পশুচিকিৎসা সেবার মাধ্যমে ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
ডুমুরিয়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নজুড়ে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও বৃহৎ খামারি দেশীয় গরুর পাশাপাশি সিন্ধি, অস্ট্রেলিয়ান ও পাকিস্তানি জাতের গরু লালন-পালন করছেন। এসব পশু খড়, ভূষি, গম, গুড় ও সবুজ ঘাসের প্রাকৃতিক মিশ্রণে মোটা করা হচ্ছে।
রঘুনাথপুর গ্রামের খামারি মীনু সাহা তার বিশাল ৪০ মণ ওজনের চার বছর বয়সী গরু ‘রাজা মানিক’ এর কারণে আলোচনায় এসেছেন। তিনি এই গরুর দাম রেখেছেন ১৬ লাখ টাকা, তবে দরকার হলে ১৪ লাখ টাকায় বিক্রি করতে রাজি আছেন।
একই এলাকার খামারি আমির হামজা জানান, তিনি সম্প্রতি আটটি গরু ও ষাঁড় বিক্রি করেছেন এবং আরও পাঁচটি পশু ঈদের জন্য প্রস্তুত করছেন। তিনি বলেন, “তিনটি মাঝারি আকারের গরু প্রায় ৬০ হাজার টাকা করে বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে।”
রঘুনাথপুর গ্রামের আরেক খামারি হামিদ মিয়া জানান, তিনি এবছর ১৫টি গরু প্রস্তুত করেছেন, যার মধ্যে সাতটির ওজন ৪৫০ থেকে ৮০০ কেজি। তিনি বলেন, “আমি গরুগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে লালন করেছি—গম, মটর, ডাল ও ভুট্টার পুষ্টিকর মিশ্রণ, খড় ও ঘাস খাইয়ে। প্রতিটি গরুর খাবার ও শ্রম বাবদ প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা খরচ হয়েছে। এই বছর খাদ্যের দাম বাড়ায় মোট ফ্যাটেনিং খরচ ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।”
খুলনা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এবছর ডুমুরিয়া উপজেলায় ৯,৫৯৮ জন খামারি মোট ৪১,৮৩৬টি পশু লালন-পালন করছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আশরাফুল কবীর জানান, “নিরাপদ পশু পালন নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে প্রণোদনা ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট-এর আওতায় এনজিও ফ্যামিলি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (FDA) ৪৯ জন খামারিকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে।”
বৃহস্পতিবার খর্ণিয়া গরুর হাট পরিদর্শনে ক্রেতারা জানিয়েছেন, পশুগুলোর স্বাস্থ্য ভালো এবং দামও গত বছরের তুলনায় সহনীয়।
একজন ক্রেতা মো. জুয়েল বলেন, “এখানকার গরুগুলো ভালো অবস্থায় আছে। যেহেতু প্রথাগত পদ্ধতিতে পালিত হয়েছে, তাই স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে গরু কিনতে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।”
ডুমুরিয়ায় এবার তিনটি অস্থায়ী ও স্থায়ী পশুর হাট বসছে, যার সবগুলোতে প্রশাসন, প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও ভেটেরিনারি টিমের কঠোর নজরদারিতে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ কার্যক্রম।
প্রাকৃতিকভাবে লালিত বিপুলসংখ্যক পশু সরবরাহ থাকায় খামারি ও কর্মকর্তারা আশাবাদী যে, জৈব ও নিরাপদ পশুপালনের এই ধারা ঈদুল আজহাকে সফল ও লাভজনক করে তুলবে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্যও সহায়ক হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, এবছর খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় ১৪.৩৪ লাখ কোরবানির পশু প্রস্তুত হয়েছে, যা চাহিদার ১০.৪৭ লাখের তুলনায় অনেক বেশি।
গত বছর প্রস্তুত হয়েছিল ১১.৮২ লাখ পশু এবং বিক্রি হয়েছিল ৮.০৯ লাখ।
ডা. নুরুল্লাহ মো. আহসান, খুলনা বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ পরিচালক, বলেন, “কঠোর নজরদারি ও পশুর স্বাস্থ্যের উন্নয়নের ফলে খামারিদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। রাসায়নিক ফ্যাটেনিং কমে এসেছে, লাম্পি স্কিন রোগও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই আমরা আশা করছি, এবার ১০ লাখেরও বেশি পশু বিক্রি হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এবছর ২.২১ লাখ পশু প্রাকৃতিক ও নিরাপদ পদ্ধতিতে মোটা করা হয়েছে, যদিও খাদ্যের ক্রমবর্ধমান দাম অনেক খামারির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।”
ডা. আহসান বলেন, “ঈদুল আজহা গ্রামীণ জীবিকায় সহায়তা করে। এটি গরু খামারিদের জন্য বছরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক সুযোগ।”