ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের প্রার্থীদের যোগ্যতা নির্ধারণে ‘গ্রেডিং পদ্ধতি’ চালু করেছে। ছয়টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করবে বলে জানাচ্ছে দলটি। ইতোমধ্যে দেড় হাজারের বেশি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে তাদের। আগামী রোববার ও সোমবার ঢাকার আবু সাঈদ কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত হবে এনসিপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার।
দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজনীতিবিদ, শ্রমিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আলেমসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এনসিপির মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, বৈধ আয় ও আর্থিক স্বচ্ছতাসহ অন্তত ছয়টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে করা হবে প্রার্থীদের গ্রেডিং।
দল গঠনের পর নানা সংশয় ও সমালোচনার মুখে পড়লেও এনসিপির মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরুর পর দলটি ঘিরে আগ্রহে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। তরুণ নেতৃত্বের এই দলকে ঘিরে মাঠপর্যায়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ফরম বিক্রির প্রথম দিন থেকেই বাংলামোটরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। শুধু দলীয় নেতাকর্মীই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা, শ্রমিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আলেমসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে মনোনয়ন ফরম নিতে দেখা গেছে। অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যা নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে।
কোনো আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলে নির্দিষ্ট গ্রেডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রার্থী চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাই করা হবে। এতে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, বৈধ আয়ের উৎস, আর্থিক স্বচ্ছতা, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত সংক্ষিপ্ত ইশতেহার এবং ব্যক্তিগত মোটিভেশন- এসব মানদণ্ড কঠোরভাবে বিবেচনায় নেওয়া হবে
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ
গত ২০ নভেম্বর পর্যন্ত দলটি মনোনয়ন ফরম বিক্রির কাজ সম্পন্ন করেছে। তিনশ আসনের বিপরীতে ইতোমধ্যে দেড় হাজারের বেশি আগ্রহী ব্যক্তি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। নতুন নেতৃত্বের ওপর ভরসা করে অনেকে এনসিপিকে দেশের রাজনীতিতে সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে দেখছেন বলে মনে করছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভিড় এনসিপির গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাবের দিকেও নতুন করে ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলে নির্দিষ্ট গ্রেডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রার্থী চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাই করা হবে। এতে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, বৈধ আয়ের উৎস, আর্থিক স্বচ্ছতা, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত সংক্ষিপ্ত ইশতেহার এবং ব্যক্তিগত মোটিভেশন- এসব মানদণ্ড কঠোরভাবে বিবেচনায় নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সামগ্রিক যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থীদের শর্টলিস্ট তৈরি করা হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গত ৬ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করলেও নির্ধারিত সময়সীমা ছিল ১৩ নভেম্বর। প্রথম পর্যায়ে ১,০১১টি ফরম বিক্রির পর আবেদনকারীদের আগ্রহ বিবেচনায় সময় বাড়িয়ে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত করা হয়
গত ২০ নভেম্বর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের মনোনয়ন ফরম বিতরণ শেষ হয়েছে। আশা করছি, চলতি মাসেই প্রথম ধাপের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গত ৬ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করলেও নির্ধারিত সময়সীমা ছিল ১৩ নভেম্বর। প্রথম পর্যায়ে ১,০১১টি ফরম বিক্রির পর আবেদনকারীদের আগ্রহ বিবেচনায় সময় বাড়িয়ে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এ সময় বিভিন্ন সংসদীয় আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মিছিলসহ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে আসেন। ঢাক-ঢোল, ব্যান্ড পার্টি নিয়ে এসেও অনেককে ফরম কিনতে দেখা গেছে।
২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয় থেকে ঢাকা-৮ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন জুলাইয়ের আলোচিত রিকশাচালক মো. সুজন। তিনি বলেন, কেউ এতিমের টাকা মেরে, যাত্রাপালা করে যদি সংসদে যেতে পারেন, আমি রিকশাচালক হয়ে কেন সংসদে যেতে পারব না?
সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে দলগত অবহেলা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মনোনয়নকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে বিভিন্ন দলের যেসব নেতাকর্মী প্রান্তিক হয়ে পড়েছিলেন, তারা এখন দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই প্রেক্ষাপটে নিজেদের একটি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। যেখানে যোগ্য সবাই তাদের রাজনৈতিক সক্ষমতা ও নেতৃত্ব প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন।
দলটির নেতাদের মতে, প্রচলিত স্বার্থনির্ভর কিংবা গোষ্ঠীনির্ভর রাজনীতির বাইরে এসে বাংলাদেশকেন্দ্রিক ও জাতীয় স্বার্থ–অভিমুখী রাজনীতি গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য। স্বাধীনতার পঞ্চম দশক-পরবর্তী সময়ে স্থায়ী উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত করতে যোগ্য, দেশমুখী নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। যোগ্য বাংলাদেশপন্থী নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া চব্বিশ-পরবর্তী সময়ে দেশের স্থায়ী উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামী রোববার আবু সাঈদ কনভেনশন হলে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারী ও প্রার্থী হতে আগ্রহীদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হবে। আমরা এটাকে ইন্টারভিউ বলছি না, বলছি মতবিনিময় সভা। সেদিন আমাদের ১০টি সাংগঠনিক বিভাগের অধীনে ৩০টি সাব-বোর্ড কাজ করবে। এসব বোর্ডের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই প্রাথমিক শর্টলিস্ট তৈরি করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী। প্রতিটি আসনে যদি নতুন নেতৃত্বকে সামনে আনতে পারি, তাহলেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে। কেউ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে যেতে পারলে সেটা অবশ্যই বড় অর্জন। তবে আমাদের মূল অর্জন হলো- ৩০০ আসনে তরুণদের মধ্য থেকে আগামী দিনের বাংলাদেশের নেতৃত্ব গড়ে তোলা।
দলের এই যুগ্ম সদস্য সচিব আরও বলেন, কিছু তথ্য আমরা সিভি ও অন্যান্য উৎস থেকে পাবো, আর বাকিগুলো প্রার্থীদের জমা দেওয়া নথি থেকে আসবে। সব মিলিয়ে একটি প্রাথমিক গ্রেডশিট তৈরি করা হবে। এরপর প্রয়োজন হলে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টসহ অতিরিক্ত তথ্য যোগ করে আমরা চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করব।
মনোনয়ন ঘোষণার সময় সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি আগামী বৃহস্পতিবার বা শুক্রবারের মধ্যে হতে পারে। তবে এখনো অনেকেই আগ্রহী থাকায় সিদ্ধান্তটি খুব সতর্কভাবে নিতে হচ্ছে। কারণ, একবার ঘোষণা হয়ে গেলে পরে পরিবর্তন করা কঠিন।
বিভিন্ন আসনে এনসিপির সম্ভাব্য প্রার্থী
এনসিপি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি ঢাকা-১৮ আসনে প্রার্থী হতে পারেন। কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনে দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, ঢাকা-৯ আসনে তাসনিম জারা, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও কৃষিবিদ উইংয়ের প্রধান সমন্বয়ক গোলাম মর্তুজা, রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে জাতীয় যুব শক্তির কেন্দ্রীয় সংগঠক ও রংপুর বিভাগীয় উপকমিটির সদস্য কৃষিবিদ মাসুম বিল্লাহ মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এসব আসনে তারাই প্রার্থী হতে পারেন।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকা-১১ (বাড্ডা, ভাটারা ও রামপুরা) আসনে এবং সদস্য সচিব আখতার হোসেন রংপুর-৪ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম পঞ্চগড়-১, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ঢাকা-১৪ আসনে প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া কক্সবাজার-২ এ এস এম সুজা উদ্দিন, কুমিল্লা-১০ জয়নাল আবেদীন শিশির, ঢাকা-১৩ আকরাম হুসেইন, ভোলা-১ সামান্তা শারমিন, নরসিংদী-২ সারোয়ার তুষার, নোয়াখালী-৬ আবদুল হান্নান মাসউদ, নারায়ণগঞ্জ-৪ আবদুল্লাহ আল আমিন, কুড়িগ্রাম-২ আতিক মুজাহিদ, ফেনী-২ সালেহ উদ্দিন সিফাত, চুয়াডাঙ্গা-১ মোল্লা ফারুক এহসান, চট্টগ্রাম-১৬ মীর আরশাদুল হক, ঝালকাঠি-১ মশিউর রহমান, ঢাকা-৫ নিজাম উদ্দিন, সিরাজগঞ্জ-৫ মাহিন সরকার, নওগাঁ-৫ মনিরা শারমিন, পটুয়াখালী-২ মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আশরাফ উদ্দীন মাহাদী, সিরাজগঞ্জ-২ এস এম সাইফ মোস্তাফিজ, বাগেরহাট-৩ মোল্যা রহমতুল্লাহ, ফেনী-১ এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, নীলফামারী-৪ আবু সাঈদ লিয়ন, ঝালকাঠি-১ আরিফুর রহমান তুহিন এবং মেহেরপুর-২ আসনে সাকিল আহমদ প্রার্থী হবেন বলে দলটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।


