
মূলত মোগলদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঢাকার শবেবরাত পেয়েছে উত্সবের রূপ। বাঙালির শবেবরাত উদযাপনে এখন নানা আয়োজন আর বিশেষ পদের খাবার জায়গা করে নিয়েছে। ঢাকা গবেষক সাদ উর রহমান লিখেছেন ঢাকার শবেবরাত উদযাপন নিয়ে
ফারসি শব্দ শব অর্থ রাত বা রজনী এবং বরাত শব্দটির অর্থ ভাগ্য। দুই শব্দের অর্থ একত্রে দাঁড়ায় ভাগ্যরজনী।
আরবি ভাষায় এ রাতটিকে লাইলাতুল নিছফি মিন শাবান, অর্থাত্ শাবান মাসের মধ্যে অন্যতম রজনী হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ রাতে মুসলমানরা মহান আল্লাহর কাছে মার্জনা প্রার্থনা করে থাকেন।
এ কারণে এ রাতকে লাইলাতুল বারকাত বা শবেবরাত বলা হয়। ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশে এ মাসের একটি রজনীকে শবেবরাত বলা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়ার কিছু এলাকা ছাড়া কোথাও ঘটা করে শবেবরাত পালন করা হয় না। এ রাতে গুনাহ ও পাপের অশুভ পরিণাম থেকে মুক্তি পেতে রহমতের জন্য প্রার্থনা করে থাকেন অনেকে। সন্ধ্যার পর থেকে পাকপবিত্র হয়ে ঘরে নফল নামাজ আদায় করেন। কেউ কেউ মসজিদে নামাজ, জিকির-আসকার ও দোয়ায় শরিক হন।
বাড়িতে তৈরি বিশেষ পদের মধ্যে থাকে নানা রকম বিরিয়ানি, তেহারি
শবেবরাত কোনো ধর্মীয় উত্সব নয়। কিন্তু বাঙালি একে উত্সবের রূপ দিয়েছে। এদিন তারা মসজিদ, খানকায় আলোকসজ্জা, কবর জিয়ারত, আতশবাজি ফোটানো ও বিশেষ খাবারের আয়োজন করে থাকে। শবেবরাতকে এই রূপদানে বিশেষত ঢাকাবাসী ঢাকার নবাব-নাজিমদের দৃষ্টান্ত ও উদযাপনের ধরনকেই অনুকরণ করে আসছে। কেননা এখানকার নবাব-নাজিমরা ছিলেন শিয়া অধ্যুষিত মোগল ঘরানার উত্তরসূরি।
ঢাকার ঘরে ঘরে এই দিন সবাই নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, ইতেকাফ, কবরস্থানে গিয়ে জিয়ারত করে কবরবাসীর জন্য দোয়া করে। বাড়িঘরে বিশেষ খাবারদাবারের আয়োজন করা হয়। শবেবরাতের উত্সবের রূপ দেখা যায় বিশেষত পুরান ঢাকার মহল্লায় মহল্লায়।
নবাবি আমলে মসজিদে আলোকসজ্জা, মোমবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, বাজি ফোটানো, তারাবাতি জ্বালানো ছিল আবশ্যক। সেকালে শ্যালক-শ্যালিকাদের জন্য মোমবাতি, আতশবাজি, তারাবাতিসহ নানা ধরনের বাজি উপহার হিসেবে পাঠানো হতো। কিশোর-যুবকরা বাজি ফোটাত। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠত। একে চোঙা খেলা বলা হতো। কিশোর-যুবকরা নামাজের অসিলায় সারা রাত ঘরের বাইরে থাকার অনুমতি পেয়ে দুষ্টুমি করে বেড়াত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যেমন ঘরে, মন্দিরে, সমাধিস্থলে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে শ্যামাপূজা বা কালীপূজা উদযাপন করে, ঠিক তারই আদলে ঢাকায় পালিত হতো শবেবরাত। দীর্ঘ পরিক্রমায় মুসলমান সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সচেতনতা আর সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ হয়েছে শবেবরাতের এই আতশবাজি খেলা।
তবে এখনো ঢাকায় শবেবরাতকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে তৈরি হয় রুটি ও হালুয়ার বিশেষ পদ। রুটি বলতে সামর্থ্য অনুযায়ী আটার রুটি, চালের রুটি, ময়দার রুটি তৈরি হয়। চকবাজার মসজিদের সামনে শবেবরাতকে কেন্দ্র করে রাস্তা ও দোকানে বিক্রির জন্য থরে থরে সাজানো হয় দৃষ্টিনন্দন পাউরুটি ও বনরুটি। বেকারিগুলোতে তৈরি হয় পাখি, কুমির, কাচ বসানো পুঁতি দিয়ে নকশাদার বিশাল ওজনের প্রতীকী সব রুটি। এই রুটিকে শবরাতি রুটি বলা হয়। বনরুটিকে বলা হতো বোগদাদি রুটি, যা তৈরি হতো সাধারণের জন্য। একসময় শিরমাল ও রওগান শিরমাল রুটির প্রচলন ছিল। এখন নির্দিষ্ট কিছু নামকরা বেকারিতেই পাওয়া যায়; যদিও সেই রুটি মানসম্মত নয়। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো অবস্থা আর কি!
হালুয়ার কথা বলি, শবেবরাত উপলক্ষে ঢাকার ঘরে-বাইরে এত পদের অভিনবত্বের হালুয়া তৈরি হয়, যা উপমহাদেশের অন্য কোনো শহরে দেখা যায় না। ছানার মিষ্টান্ন প্রচলন বিশ শতকের প্রথম ভাগে। তত্কালীন মুসলমান হালুয়াইরা উত্তর ভারত থেকে এসে ঢাকায় সুজি ও ময়দার মিষ্টান্নের প্রচলন করে ঢাকার মিষ্টান্নশিল্পে নতুন এক স্বাদ যোগ করে। শবেবরাতে দেখা যায়, বুট বা ছোলা, ডিম, সুজি, নেসাশতা, বাদামের হালুয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন ফল-সবজি (গাজর, লাউ, পেঁপে, আম, কমলা, নারকেল ইত্যাদি), সোহান (হাফসি, পাপড়ি, দুধিয়া), মাসকাট, বরফিসহ অসংখ্য পদের হালুয়া, যা ঢাকার ঘরে ঘরে তৈরি হয়। হালুয়া-রুটি তারা নিজেরা খায়, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বিলিয়ে দেয়। এই বিশেষ রাতে দরিদ্র অসহায়দের জন্য দান-খয়রাত ও খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়।
শবেবরাত উপলক্ষে ঢাকার সচ্ছল পরিবারগুলোতে পোলাউ, তেহারি, ভুনা খিচুড়ি, হাঁসের মাংস রান্না করতে দেখা যায়। রাত জেগে নামাজ আদায় ও বিশেষ রাত উপলক্ষে সব পরিবারই একটু ভালো খাবার ও ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোনিবেশ করে। এই রেওয়াজটা যে প্রাচীন, তা অনুমান করাই যায়। মহররম, ঈদে মিলাদুন্নবী, ফাতেহা ইয়াজদাহম, শবেকদরসহ নানা ধর্মীয় পর্বও ঢাকার নবাবরা বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতেন।
শবেবরাত মুসলমানদের পবিত্র একটি রাত। সবাই ইবাদত-বন্দেগি, দোয়া পাঠ, মিলাদ মাহফিল আয়োজনে সময় কাটায়। ধর্মীয় বিধি-বিধান না থাকলেও একটু ভালো খাবার, দান-খয়রাত, প্রতিবেশীসুলভ বিলি-বণ্টন, বিনিময়, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধনকে আরো জোরালো করে। সেটি ঢাকার লোকেরা ইবাদত-বন্দেগির ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে উত্সবের আমেজে আজও অতিবাহিত করে। কারণ পক্ষকাল পরই আসবে মুসলমানদের রহমত, বরকত ও নাজাতের মাহে রমজান। মুসলমানদের দীর্ঘ খুশির মাস।
পিএসএন/এমঅাই