আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক প্রধান সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক বেঁচে আছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তিনি এখন কোন বেশে, কোথায় অবস্থান করছেন তার সুস্পষ্ট কোনো তথ্য তাদের হাতে নেই। জিয়ার এমন রহস্যময় অবস্থান উদ্বেগ ও আতঙ্কের বলে মনে করছেন তাকে অনুসন্ধানকারী পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা।
গতকাল রবিবার পুলিশের এসব কর্মকর্তা জানান, জিয়াকে ধরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার ঘোষণার কয়েক দিন পর বিদেশি একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তারা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়ান। জিয়ার বিষয়ে আগের সংরক্ষিত ও অন্যান্য দেশের গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে তার অবস্থান শনাক্ত হয়। এরপরই পুলিশের একাধিক দল ‘জিয়াকে তাদের কবজায়’ নেয়। তবে পরে জিজ্ঞাসাবাদে বুঝতে পারেন নিশ্চিত জিয়া ভেবে যাকে ধরা হয়, তিনি মূলত কাঁচপুর এলাকার একজন ভ্যানচালক। যদিও জিয়ার সম্ভাব্য গতিবিধির সঙ্গে তার গতিবিধি এবং অন্যান্য তথ্যের ৯০ ভাগ মিল ছিল বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পরে আরও তথ্য সংগ্রহ করে নিশ্চিত হন তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড জিয়া নন।
জিয়াকে অনুসন্ধানকারী পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, জিয়ার অবস্থান শনাক্তে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বের প্রায় সব দেশের ইমিগ্রেশনের ডাটা বিশ্লেষণ করেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় ও বিশ্লেষণে জিয়ার অবস্থান কাঁচপুরে বলে তাদের নিশ্চিত করা হয়েছিল।
জিয়ার অবস্থানের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জিয়া দেশে না বিদেশেএ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। বর্তমানে দেশে কোনো হামলার সক্ষমতা জঙ্গিদের নেই। তবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এজন্য বিষয়টি আমাদের সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণে রয়েছে।’ আফগানিস্তান ও ইরানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘শিয়ারা ক্ষমতা দখলের পরই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত ভূমিকা নিয়েছে। তারা তাদের নিজস্ব পরিকল্পনায় এগোচ্ছে। আমরাও কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতির বাইরে নই।’
জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী পুলিশের আরেক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, জিয়াকে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে পুরস্কার ঘোষণাকারী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার অতীত ইতিহাস বলছে, মোস্ট ওয়ান্টেড কোনো ব্যক্তির প্রায় পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে পাওয়ার পরই তারা এ ধরনের ঘোষণা দেয়। ফলে এ ধরনের জঙ্গির প্রকৃত অবস্থান তারাই ভালো জানে। তারা যেসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সোর্স ব্যবহার করে, সেখানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে খুব সহজে হামলাকারী তৈরি করা যায়, যেটি নব্য জেএমবির ক্ষেত্রে দেখা গেছে। পুলিশের বেশ কয়েক কর্মকর্তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে, যেকোনো সময় জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। আবার নিজস্ব চ্যানেলে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে রক্তের বদলে রক্ত ঝরাতে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ঘোষণাও আতঙ্ক তৈরি করছে।
গত ২০ ডিসেম্বর লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং জঙ্গিনেতা আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনানের বিষয়ে তথ্য চেয়ে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘোষণার পর নতুন করে জিয়ার অনুসন্ধানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুর্বৃত্তরা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে। হামলায় আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদ। তারা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। অভিজিৎ রায় হত্যার পর জড়িতদের ধরতে পুলিশ সদর দপ্তরও পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ২০১৬ সালের ২ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, নিষিদ্ধ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলামের সামরিক কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন জিয়া। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড তিনি। মোট ১১টি মামলার ছয়টিতে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। জিয়া ২০১১ সাল থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন।
পিএস/এনআই