রাজধানীর বনানীতে নারী সার্জেন্টের বাবাকে চাপা দেওয়া সেই বিএমডব্লিউ গাড়িটি একমাসেও জব্দ করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি পুলিশ গাড়িটির চালক বিচারপতির ছেলে সাঈদ হাসানকেও খুঁজে পায়নি।
সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের ভাই মৃত্যুঞ্জয় হাজংয়ের অভিযোগ, পুলিশ মামলার তদন্তের চেয়ে বিচারপতির ছেলের জিডির তদন্ত করছে আগে। তারা একমাসেও গাড়ি ও চালক কাউকেই খুঁজে পায়নি।
অপরদিকে সেই বিচারপতির পক্ষ থেকে তাদের আপোষ করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মৃত্যুঞ্জয়কে একটি সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভনও দেখানো হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানান দিক থেকে চাপ আসছে। বিভিন্ন রকম প্রলোভনও দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমি বলে দিয়েছি, ওসব আমরা কিছুই চাই না। আমরা ন্যায়বিচার চাই।’
গত বছরের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী এলাকার চেয়ারম্যানবাড়ি সড়কে একটি দ্রুতগতির বিএমডব্লিউ গাড়ির চাপায় আহত হন নারী সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের বাবা মনোরঞ্জন হাজং। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে শ্যামলীর পঙ্গু হাসপাতালে ও পরে শাহবাগে বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অস্ত্রোপচার করে তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আহত মনোরঞ্জন হাজং এখনও বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে।
আলোচিত এই সড়ক দুর্ঘটনার পর পুলিশ সদস্য হয়েও বনানী থানায় মামলা করতে গেলে প্রথমে মামলা নিতে চায়নি পুলিশ। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে ঘটনার ১১ দিনের মাথায় একটি মামলা নেয় থানা পুলিশ। তবে মামলা নেওয়ার আগেই সেই বিচারপতির ছেলে সাঈদ হাসান বনানী থানায় একটি জিডি করেন। সেই জিডিতে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করলেও সড়কে উল্টো দিক থেকে মনোরঞ্জন হাজংয়ের মোটরসাইকেলটি অতিক্রম করছিল বলে অভিযোগ আনা হয়।
মামলা ও জিডির তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত করে আইন অনুযায়ী যা করণীয় তাই করা হবে। আদালতে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সব কাজ গুছিয়ে আনা হচ্ছে।’
যোগাযোগ করা হলে একই কথা বলেন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া।
সূত্র জানায়, আলোচিত এই মামলা নিয়ে এক ধরনের বেকায়দা পড়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। একদিকে নিজেদের বাহিনীর সদস্য, আরেকদিকে বিচারপতির ছেলে। ভেতরে ভেতরে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য নানান প্রক্রিয়া চলছে। এজন্য এজাহারে বাদী নাম উল্লেখ করলেও তা বদলে অজ্ঞাতনামা হিসেবে এজাহারটি গ্রহণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচিত এই দুর্ঘটনার পরপরই পথচারীরা চাপা দেওয়া সেই বিএমডব্লিউ গাড়ি ও এর চালকসহ অন্য যাত্রীদের আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। তবে এক ধরনের চাপের মুখে গাড়িসহ তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় থানা পুলিশ। বিএমডব্লিউ গাড়িটির চালকের আসনে থাকা সাঈদ হাসান বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে। গাড়িতে তার সঙ্গে স্ত্রী অন্তরা সাঈদ ও রোয়াদ নামে এক বন্ধুও ছিল। এখন গাড়িটি জব্দ ও বিচারপতির ছেলেকে শনাক্ত করার নামে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, মহুয়া হাজংয়ের মামলাটিতে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর ৯৮ ও ১০৫ ধারা বসানো হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর ৯৮ ধারায় বেপরোয়া গতি ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর অপরাধে চালকের অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর ১০৫ ধারায় দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বা কেউ মারা গেলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
আলোচিত এই ঘটনায় প্রথম দিকে অভিযোগ তোলা বাদী পুলিশ সার্জেন্ট মহুয়া হাজং গণমাধ্যমে কথা বললেও এখন তিনি কোনও মন্তব্য করতে চান না। মামলা নিয়ে মন্তব্য করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে রয়েছেন তিনি। তাকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে মৌখিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) যোগাযোগ করা হলে মহুয়া হাজং ব্যস্ততার কথা বলে ফোন কেটে দেন।
পিএস/এনআই