আজ ২৫ মে, ভয়াল ঘূর্ণিঝড় আয়লার ১৬তম বর্ষপূর্তি। ২০০৯ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী আয়লা খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে তাণ্ডব চালায়। আজও যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিতে অম্লান সেই দুঃসহ দিনটি—যেখানে প্রিয়জনদের মুখ আর দেখা হয়নি।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে কয়রা উপজেলার অন্তত ছয়টি ইউনিয়ন লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়। উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে পড়ে ৪০টিরও বেশি স্থানে, যার মধ্যে ২৭টি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই অঞ্চলের মানুষ পরবর্তী তিন বছর লবণাক্ত পানি ঢুকে যাওয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। খুলনা উপকূলজুড়ে আয়লায় প্রাণ হারান অন্তত ৪১ জন।
ঝড়ের দাপটে ধ্বংস হয় অসংখ্য কাঁচাঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, রাস্তা-ঘাট, সেতু, কালভার্ট, মাছের ঘের, ফসল, গাছপালা ও গৃহপালিত প্রাণী। উপকূলবাসীর কাছে ‘আয়লা’ এক অভিশপ্ত স্মৃতি।
এখনও, ২৫ মে এলেই লোকজনের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কেউ কেউ স্বজনদের মরদেহ কবর দেয়ার জায়গা না পেয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পরেও ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। অসহনীয় কষ্ট সয়ে আজও টিকে আছেন তাঁরা।
সম্প্রতি কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেছে, বহু মানুষ আজও বাঁধের উপর অস্থায়ী ঘরে বসবাস করছেন। ভূমি ও সম্পত্তি হারিয়ে তাঁরা বাঁধকে আঁকড়ে ধরে আছেন, প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ সয়ে।
স্থানীয়দের মতে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাঁদের সবকিছু হারিয়ে গেছে। উপরন্তু, শাকবারিয়া, কপোতাক্ষ ও কয়রা নদীর ভাঙনে বহু ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি বিলীন হয়ে গেছে। এখন গাছপালা শূন্য কয়রার পরিবেশ খরতাপে পুড়ে ওঠে, যা মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
কয়রা সদর ইউনিয়নের ওয়ার্ড-৪ এর আয়লা-আক্রান্ত হেলাল উদ্দিন বাসস-কে জানান, আয়লার পর বহু জনপ্রতিনিধি এলেও তাঁদের প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের শেখ সরদার পাড়ার কৃষক আরিফুর রহমান বলেন, কৃষকরা কিছু ফসল ফলাতে পারলেও লবণাক্ততা পুরোপুরি কাটেনি। মেরামতের পরও বাঁধগুলো এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। যদি এগুলো পুনরায় ভেঙে পড়ে, এলাকা আবার লবণ পানিতে তলিয়ে যাবে।
কয়রা সদর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এস এম লুৎফর রহমান জানান, আয়লার পর অনেক মানুষ জীবিকার খোঁজে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে। ১৬ বছর পরও অনেকেই তাঁদের ভিটেমাটিতে ফিরতে পারেননি।
আয়লা-আক্রান্তদের মতে, টিকে থাকার জন্য টেকসই বাঁধ অপরিহার্য। বাঁধ না থাকলে এ অঞ্চলে জীবনযাপন অসম্ভব।
ঘূর্ণিঝড়ের পর কয়রায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। অনেক জায়গায় এখনো মানুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
তাঁরা বলেন, গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুকুর সংস্কার করে পুকুর বালু ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন করলে পানি সংকট কিছুটা লাঘব হতে পারে।
কয়রা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন জানান, কয়রার প্রধান সমস্যা নদীভাঙন। এটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। বহু বাঁধ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তপন কুমার কর্মকার বাসস-কে জানান, আয়লার পর কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কার করা হলেও বহু প্রতিষ্ঠান এখনও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। অনেক স্কুলে পৌঁছানোর সড়কও নাজুক, যা শিক্ষার্থীদের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ।
খুলনা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মাশিউল আবেদীন জানান, কয়রার ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি জায়গায় বাঁধ সংস্কার কাজ চলছে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায়। অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে কাজ বাস্তবায়ন হবে।
উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মমুনুর রশিদ বলেন, গত এক দশকে উপকূলে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার মধ্যে আয়লার প্রভাব ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এখনো মানুষ সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
কয়রার ইউএনও রুলী বিশ্বাস বাসস-কে বলেন, কয়রায় জীবনের নিরাপত্তা ও সম্পদ রক্ষায় টেকসই বাঁধ একান্ত জরুরি। নদী বেষ্টিত এই উপজেলায় বাঁধই জীবনরেখা। প্রতিবছর কোনো না কোনো স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবন হয়। ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পেতে টেকসই বাঁধ ব্যবস্থাই একমাত্র সমাধান।