স্কুবা ডাইভিং সেন্টারে আট মাসের বেশি সময় আছেন, তবু শখ করে কোনো দিন ডাইভিং করেননি মহব্বত আলী। তাঁর এই পানিভীতির কথা তত দিনে সেন্টারের সবার জানা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে খোঁচাও হজম করতে হয়। তাতে অবশ্য মহব্বতের কিছু যায় আসে না—যা করতে ভয় লাগে, সেটা তিনি কেন করবেন!
একদিন অবশ্য মহব্বতকে সাগরে ডুব দিতেই হলো। দিনটি ২০১১ সালের ১০ জানুয়ারি। মহব্বত আলীর ২৬তম জন্মদিন। তিনি যে রিসোর্টের ডাইভিং সেন্টারে কাজ করেন, তার ব্যবস্থাপক মাত্তেও মনতানারির কড়া নির্দেশ, ‘মহব্বত, আজ তোমাকে পানিতে নামতেই হবে।’ ইতালীয় বসের এমন নির্দেশেও মহব্বত পানিতে নামতে চাইলেন না। তবে সেন্টারের অন্যরাও অনড়, মহব্বতকে ধরে জেটিতে নিয়ে গেল সবাই। তারপর ডাইভিং স্যুট, মাস্কসহ অন্য উপকরণ পরিয়ে ফেলে দিল পানিতে। শুরুতে ভয় পেলেও পরে মহব্বত বুঝলেন এ তো মজার খেলা। এরপর একে একে অন্য সহকর্মীরা নামলে বেশ আনন্দ করলেন সেদিন।
সেই থেকে নোনাপানির সঙ্গে সখ্য। প্রায়ই পানিতে নামেন। ডাইভিংয়ের চেষ্টা করেন। মনে মনে ভাবেন, যদি ডাইভিং শিখতে পারতাম! এমনই একদিন সেই ব্যবস্থাপকই মহব্বতকে প্রস্তাব দিলেন, ‘তুমি ডাইভিংয়ের প্রাথমিক কোর্সটা করে ফেলো।’
কিন্তু কীভাবে? এ জন্য ফি লাগবে, যেতে হবে অন্য সেন্টারে। মহব্বত বলেন, ‘তারও সমাধান করলেন ম্যানেজার। আমাদের রিসোর্টে পারফম্যান্সের ওপর কর্মীদের কাউকে ছুটি দিত, কাউকে দিত বোনাস। সেবার আমাকে আমার বস ছুটিসহ এই কোর্স করার সুযোগ দিলেন।’
সাত দিনের ছুটিতে পাশের একটি ডাইভিং সেন্টারে গিয়ে ‘ওপেন ওয়াটার ডাইভিং কোর্স’ করলেন মহব্বত। দক্ষতার সঙ্গে কোর্সটা করায় প্রশিক্ষকের বাহবা পেলেন, আর পেলেন নির্দেশনা, ‘তুমি চাইলে কিন্তু ডাইভমাস্টার হতে পারো, আমরাও তো ধীরে ধীরেই শিখেছি।’
ভীষণ অনুপ্রাণিত হলেন মহব্বত। তারপর দিনে দিনে নিজের ভাষাগত দক্ষতাও বাড়ালেন। ইংরেজির পাশাপাশি শিখতে থাকলেন ইতালীয় ভাষা। সেন্টারে তাঁর দায়িত্বও বাড়ল। জোগালির কাজ ছেড়ে অতিথি অভ্যর্থনা, তাদের চাহিদা অনুযায়ী সরঞ্জাম সরবরাহ আর সেসব বুঝিয়ে নেওয়ার কাজ তাঁর ওপর বর্তাল। এ দিকে তাঁর মাথায় ডাইভিংয়ের পোকাটা ভালোভাবেই বাসা বেঁধেছে। অ্যাডভান্সড ওপেন ওয়াটার কোর্সটা এবার করতে হবে। সেন্টারে বললেন নিজের আগ্রহের কথা। মহব্বতের বেতন থেকে মাসে মাসে কেটে নেওয়ার শর্তে তাঁকে সেই কোর্সেও পাঠানো হলো।
কোর্স শেষে মহব্বত এবার স্কুবা করতে আসা পর্যটকদের ব্রিফ করা, তাদের গাইড করে সমুদ্রে নেওয়া শুরু করলেন। সেখানে ডাইভমাস্টারের হাতে তুলে দিয়ে নিজে বোটে বসে বসে দেখতেন আর ভাবতেন তিনিও কবে ডাইভমাস্টার হবেন। এরপর রেসকিউ কোর্স করলেন। বেতন বাড়ল, বাড়ল দায়িত্ব। মাত্তেও মনতানারি রিসোর্ট পরিবর্তন করে অন্য একটি রিসোর্টে গেলেন। মহব্বত আগের রিসোর্টেই থেকে গেলেন। তবে সাবেক বসের ডাক পেয়ে মহব্বত গেলেন তাঁর কাছে। এই বসের সহযোগিতায় ২০১৯ সালে স্নোরকেলিং ইনস্ট্রাক্টর কোর্স করে একই পদে নিয়োগ পান।
‘স্নোরকেলিং হলো সমুদ্রের পানিতে ভেসে ভেসে নিচে দেখা। কিন্তু আমার আগ্রহ তো স্কুবাডাইভিং, চেষ্টা করছিলাম ডাইভমাস্টার কোর্সে ভর্তি হওয়ার।’ বলেন মহব্বত।
২০২০ সালে ডাইভমাস্টার কোর্সে ভর্তি হন মহব্বত। কোর্স শেষে স্কুবা স্কুল ইন্টারন্যাশনাল (এসএসআই) থেকে পেশাদার ডাইভমাস্টার সনদও পেলেন। তত দিনে দেশে ফিরে গেছেন মাত্তেও। মহব্বতও খুঁজে নিলেন নতুন গন্তব্য—ইউ অ্যান্ড মি মালদ্বীপ। সেই থেকে ডাইভমাস্টার হিসেবে এই অভিজাত রিসোর্টেই আছেন।
হবিগঞ্জ থেকে মালে
২০০৯ সালে এক বন্ধুর বড় ভাইয়ের মাধ্যমে কাজের খোঁজে মালদ্বীপে যান মহব্বত আলী। কিন্তু দেশটিতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। রিসোর্টে কাজের কথা বলে নিয়ে গেলেও কোনো কাজ দেওয়া হচ্ছিল না। দিন দশেক কেটে যাওয়ার পর মালের একটি ছোট্ট কাপড়ের দোকানে বসানো হয় মহব্বতকে। বিক্রয়কর্মীর কাজ। কিছু একটা তো করতে পারছেন, এই ভেবেই খুশি মহব্বত। তবে মাস শেষে বাধল বিপত্তি। মালিকের কাছে বেতন চাইলে তিনি জানান, মহব্বত তাঁর কর্মী নন, তৃতীয় পক্ষের কাছে বেতন বুঝিয়ে দিয়েছেন।
যা টাকাপয়সা নিয়ে গিয়েছিলেন, তত দিনে সব শেষ। কষ্টেসৃষ্টে চলেন, গোডাউনের মতো একটা ঘরে থাকেন। কাপড়ের দোকানের মালিক একদিন তাঁকে নিজের কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেন। নিয়োগের মাস দুয়েক পর প্রথম বেতন পান মাত্র ১০০ মার্কিন ডলার (প্রায় ১০ হাজার টাকা)। কয়েক মাস পর দোকানের ম্যানেজার চাকরি ছেড়ে চলে যায়। দোকানের মালিক মহব্বতের ওপর নির্ভর করতে চান। তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, কম্পিউটার চালাতে পারে কি না। মহব্বতের সেই দক্ষতা আছে। তাঁকে ম্যানেজার পদের প্রস্তাব দেওয়া হলো। প্রস্তাব পেয়ে তিনিও খুশি। মালিক শিখিয়ে নেন কীভাবে বিল করতে হবে, ডিসকাউন্ট কীভাবে সমন্বয় করতে হয় ইত্যাদি দরকারি কাজ।
২০০১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা এগোয়নি। ঢাকায় দুবার এসে দুটি বিমা কোম্পনিতে চাকরি করে আবার হবিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান মহব্বত আলী। তারপর বাবার মুদিদোকান আর পরে নিজের সিডি–ডিভিডির দোকান সামলেছেন। এসব কাজের অভিজ্ঞতাও মালদ্বীপে কাপড়ের দোকান সামাল দিতে কাজে দিল। এভাবে বছরখানেক কাজ করার পর সেই বন্ধুর কল, ‘একটা রিসোর্টের ডাইভিং সেন্টারে কাজ আছে। প্রশিক্ষকের সহকারী।’
মহব্বতের কাছে কাজের ধরনের চেয়ে বড় কথা রিসোর্টে কাজ করতে পারবেন। বললেন, ‘রাজি।’
কাপড়ের দোকানের চাকরি ছেড়ে ডাইভিং সেন্টারে যোগ দিলেন। মহব্বত বলছিলেন, ‘দোকানের মালিক আমাকে ছাড়তে চাইছিলেন না। বেতন বাড়ানোরও প্রস্তাব দিলেন। কারণ, কয়েক মাসে তাঁর দোকানে চোখে পড়ার মতো বিক্রি বেড়েছিল। কিন্তু আমি তাঁকে বোঝালাম, রিসোর্টের কাজটাই আমি করতে চাই।’
সেই রিসোর্টে গিয়েই জলের দুনিয়ার সন্ধান পেলেন মহব্বত। রোমাঞ্চকর সেই দুনিয়ায় নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন।
২০১৪ সালে বিয়ে করেছেন মহব্বত। দুই সন্তান নিয়ে হবিগঞ্জেই থাকে তাঁর স্ত্রী। মহব্বত আলী বলেন, ‘যখন বিয়ে করি, তখন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছি। স্ত্রী–সন্তানদের সেভাবে মালদ্বীপে আনতেও পারিনি। এখন সবাইকে নিয়ে ভালো আছি।’
ডাইভমাস্টার হিসেবে প্রতি মাসে এখন তাঁর আয় ২ থেকে ৩ হাজার মার্কিন ডালার। আয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজটার প্রতি দরদও বেড়েছে। তিনি বললেন, ‘একসময় পানি ভয় পেতাম, এখন এই পানিই আমার সবচেয়ে আপন।’


