
গেলো কয়েকবছর ধরে ইরানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছেন শত্রু পক্ষের হামলায়। কখনো শীর্ষ পর্যায়ের পরমাণু বিজ্ঞানী, কখনো আবার কাসেম সোলাইমানির মতো সামরিক ব্যক্তিত্ব। এসব হামলার কোনোটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে, আবার কখনো কোনোটা হামলার পর দায় স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইজরায়েল।
সেসব হামলায় পর্যদুস্ত ইরান এই মুহুর্তে একাধিক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আর ঠিক সেই মূহুর্তেই আকস্মিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা গেলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা ৮৫ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে রাইসির নাম উঠে আসছিল। কিন্তু এখন তাঁর এ মৃত্যু যেনো ইরান প্রশাসনের কাছে ‘শোকের উপর বিরহ বিয়োগ’!
রাইসির মৃত্যুতে ইউএনএসসিতে এক মিনিটের নিরবতা পালন করা হয়, সেই ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করে ক্ষোভ উগরে দেয় ইজরায়েল। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত, গিলাদ এরদান। তিনি এই পদক্ষেপকে লজ্জাজনক ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন। এক্সে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় গিলাদ এরদান বলেন, ‘আপনারা ঠিকই দেখেছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের গণহত্যাকারী প্রেসিডেন্ট রাইসির স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে। চরম লজ্জাজনক ব্যাপার!
রোববার আজারবাইজান সীমান্তে একটি বাঁধের উদ্বোধন করে তেহরান ফিরছিলেন ইব্রাহিম রাইসি, আকাশপথেই তার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে বৈরী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এ দূর্ঘটনার নেপথ্য কারণ। তবে এর বাইরে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা করছে বিশ্লেষকরা।
ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনাস্থল খুঁজে পেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে গেছে। কুয়াশা এতটাই ঘন ছিল যে হেলিকপ্টারটি শনাক্ত করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্যাটেলাইটগুলোর সহায়তা চাইতে ইরানিদের বাধ্য হতে হয়েছে। ঠিক কি হয়েছিলো রাইসিকে বহন করা হেলিকপ্টারটিতে?
ইরান এখনো এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখা দেয়নি। একই সাথে তিনটি বিমান উড়তে থাকলেও বিস্ফোরিত হলো কেবল রাইসিকে বহন করা বিমানটিই। ব্যাপারটা রহস্যজনক লাগছে অনেকের কাছে। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে ইরান। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরি উচ্চপর্যায়ের একটি দলকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে রাশিয়া থেকে যে প্রধান দুটো পাইপলাইনের সাহায্যে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তাতে ছিদ্র হওয়ার ঘটনাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাশকতা বলে উল্লেখ করেছিলো। রাশিয়া, ইউক্রেন আর ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের তীর চালাচালির মধ্যেই ঠিক কারা এ আক্রমণ চালিয়ে থাকতে পারে, তা নিয়ে শুরু হয়েছিল ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। সুইডেন এবং ডেনমার্ক এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সেটি কোনো অপরাধীর নাম ছাড়াই শেষ হয়েছিল।
কিছুদিন আগে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। স্লোভাকিয়ার গণমাধ্যম জানিয়েছে, হামলাকারী ৭১ বছর বয়সী শপিংমলের সাবেক এক নিরাপত্তারক্ষী। ইউক্রেনে সহায়তা বন্ধ করার পরই এমন ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে ইরানের রাষ্ট্রপতি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুইজনই অদ্ভুতভাবে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, যেখানে অন্য দুটি এসকর্ট হেলিকপ্টার নিরাপদে ল্যান্ড করেছে অথচ ৩টি কপ্টারই একই আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিলো।
সোমবার স্পুটনিকের দ্য ক্রিটিক্যাল আওয়ারের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র নিরাপত্তা নীতি বিশ্লেষক মাইকেল মালুফ অনুষ্ঠানের হোস্টকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন একইসঙ্গে তিনটি হেলিকপ্টার উড়ছিল, হঠাৎ একটি আছড়ে পড়ল। কোন কিছু ছাড়াই, কোন মে ডে ছাড়াই? যদি এটি বৈরি আবহাওয়ার কারণে হয় তাহলে অন্য দুটি কীভাবে নিরাপদে ল্যান্ডিং করতে পারল? কেন প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার পারল না?
মালুফ আরও বলেন, ইরানের অভ্যন্তরে কথিত গোপন অভিযানের অনেক ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের। যার মধ্যে পাইপলাইনে বোমা বিস্ফোরণ, পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করা। এমনকি ইরানের অভ্যন্তরে থেকে ইরানের হামলার জবাব দেওয়া।
মালুফ অভিযোগের তীর ছুড়ে দিয়েছেন ইজরায়েলের দিকে। তিনি বলেন, ‘এটি খুব তুচ্ছ প্রতিক্রিয়া ছিল ইসরায়েলের বলে আমি মনে করি। এটি অনেক বড় কিছু করতে পারে ইসরায়েল তার আভাস দিয়েছিলো।’
‘এছাড়া অন্যান্য ঘটনাগুলো যেগুলো পশ্চিমা বিশ্বে ঘটছে- যার মধ্যে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা চেষ্টা, বাল্টিক সাগরের নিচে গ্যাস পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া, এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে না। সেখানে আরও বড় কিছু হচ্ছে। আমি মনে করি, এগুলোতে কেউ নাক গলানোর চেষ্টা করছে।’ যোগ করেন তিনি।
ইরানের প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আফ্রিকার দেশ কঙ্গতে একটি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালানো হয়।কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (ডিআরসি) সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা এই অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। এসময় তিন মার্কিনসহ মোট ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কথিত হোতা ক্রিশ্চিয়ান মালাঙ্গা নিহত হন। এই মালাঙ্গা কে ছিলো? মালাঙ্গা ২০১৫ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন বলে জানা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ইরান ও ইসরায়েলের বৈরিতা চলে আসছে ঐতিহাসিভাবে। সাধারণ ইরানিরা অনুমান করছেন, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে ইসরায়েলের হাত থাকতে পারে কোনোভাবে।
মালুফ আরও বলেন, ‘যদি রাইসির মৃত্যুর সঙ্গে ইসরায়েলের জড়িত থাকার ন্যূনতম প্রমাণও পাওয়া যায়, তবে ইরানের পক্ষ থেকে এর জবাব স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’
রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য ইজরায়েল জানিয়ে দিয়েছে তারা এর সাথে কোনোভাবেই জড়িত নয়। তবে সেই বার্তার মধ্যেও ছিলো তাচ্ছিল্যতা, উদ্ধত আর সমালোচনার বিষবাষ্প। রাইসির হাতে রক্তের দাগ লেগে ছিলো বলেও মন্তব্য করে তারা। সেই বার্তায় আরও ছিলো, রাইসি ইজরায়েলকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো অথচ এখন তিনিই ইতিহাসের পাতায় চলে গেলেন।
সত্যিই যদি রাইসির মৃত্যুতে ইজরায়েলের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মেলে তবে অশান্ত মধ্যপ্রাচ্য আরও অশান্ত হয়ে উঠবে।
সাকিবুর রহমান
শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি
স্টাফ রিপোর্টার, প্রতিদিন সেবক