উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বুকভরা আশা নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্যাম্পাসে, দেখতে দেখতেই পেরিয়ে গেছে তারুণ্যের সাত-আটটি বছর। এরই মধ্যে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন কেউ, আবার কেউ কেউ ছাড়ার অপেক্ষায়। খুব কম হলেও জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো এখানেই ছড়িয়ে আছে তাদের। এবার বাজছে আনুষ্ঠানিক বিদায় ঘণ্টা।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পা রাখার পর নানাভাবে স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এই ক্যাম্পাস। যে ক্যাম্পাসে সারাদিন মাতিয়ে রাখতেন আড্ডায়, বিকালের মিষ্টি রোধে মল চত্বরে ক্রিকেট-আড্ডা শেষে সন্ধ্যায় কার্জন, টিএসসিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বন্ধু-বান্ধবীর কণ্ঠে আবৃত্তি শুনতেন, বন্ধুর গিটারে গলা মেলাতেন, আর রাত-বিরাতে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়া; সবই কেবল স্মৃতি হয়ে রইবে কর্মব্যস্ত জীবনে। এসব কিছু স্মরণ করেই হৃদয়ের গহীনে বেদনার তীর যেন ফাল হয়ে বিঁধছে ঢাবি গ্রাজুয়েটদের।
অন্যদিকে সমাবর্তন প্রতিটা শিক্ষার্থীর জীবনে একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। যেই মাহেন্দ্রক্ষণে পৌঁছাতে পেরে এবং সেই স্মরণীয় মুহূর্তে উপস্থিত হতে পেরে ব্যথা চাপিয়ে মনের মধ্যে একটা ভালো লাগার শিহরণ কাজ করছে তাদের। এ যেন আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত বিদায়ী কাব্য।
শনিবার (১৯ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন। সমাবর্তনের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে দুপুর ১২টায়। আর শেষ মুহূর্তে স্মৃতির খাতা আরেকটু ভারী করতে এখন ব্যস্ত গ্র্যাজুয়েটরা।
সকাল থেকে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), কলাভবন, অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য, বটতলা, সিনেট ভবন, মল চত্বর, কার্জন হলসহ ক্যাম্পাসের প্রায় সব পয়েন্ট গ্রাজুয়েটদের পদচারণায় মুখর। কালো গাউন, সমাবর্তনের বিশেষ হ্যাট পরিহিত গ্র্যাজুয়েটরা শেষ সময়ের স্মৃতি ক্যামেরায় বন্দি করছেন। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবী, পরিবার-পরিজনদের নিয়ে এসেছেন তারা। কেউ কেউ সন্তানদের সঙ্গে নিয়েও অংশ নিচ্ছেন সমাবর্তনে।
সমাবর্তনে অংশ নেওয়া গ্র্যাজুয়েট মাজহারুল ইসলাম রবিন বলেন, মনে হচ্ছে এইতো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। এই পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজারও স্মৃতি। কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসে ক্রিকেট খেলে। যখন ছেড়ে যাওয়ার সময় হলো, তখন মনে হচ্ছে যেন জীবন থেকে একটা অংশ চলে যাচ্ছে। তবে সমাবর্তন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের একটা দিন। এইটা ভেবেই মনের মধ্যে একটা ভালো লাগার শিহরণও কাজ করছে।
তামান্না তাসনিম উপমা নামে এক শিক্ষার্থী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ভর্তির পর একের পর এক নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, নতুনভাবে নিজেকে জানা, কখনও ভালো তো কখনো খারাপ, ভেঙে পড়ে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখা; সবমিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা রহস্য হয়ে থাকলো আমার কাছে। এর মধ্যে সব কিছু আছে— ভয়, ভালোলাগা, কষ্ট, আপনজন সবকিছুই। খারাপ কিছু স্মৃতি থাকলেও ভালো কিছুই ছিল অনেক। এখানে এসেই ভালো কিছু বন্ধু পেয়েছি, যারা মনে দাগ কেটে দিয়েছে সারাজীবনের জন্য। টিএসসিতে তেমন আড্ডা কখনও দেইনি তবে যতটুকুই দিয়েছে পুরোটা সময় স্মৃতিতে আটকে গেছে।
উপমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ‘হল লাইফ’। তিনি হলের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘হলের এই সাতটা বছর কখনোই ভোলার না। বাসা থেকে বের হওয়ার পর হলই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। পেয়েছি ভালো কিছু শিক্ষকদের স্নেহ, আর এমন গুরুত্বপূর্ণ জীবন নির্দেশনা যেগুলো পরবর্তী জীবনে ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা দেবে। বলতে গেলে আসলে শেষ হবে না। এই এক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের উত্থান-পতন থেকে শুরু করে আবার নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। শেষ পরীক্ষাটা দেওয়ার সময়ও মনে হয়নি যে, এই জায়গাটা পরের দিন থেকে আর আমার অধিকারের আওতায় থাকবে না।
পিএসএন/এমঅাই